Sovan Chatterjee

অথ ব্যানার কথা: নেপথ্যে শোভনের ঘনিষ্ঠরা, নাকি অন্য কোনও রহস্য?

শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নামে আচমকা এত ব্যানার ছাপিয়ে লাভটা কাদের হল? এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও অধরা।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ১৮:৪০
Share:

দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় শোভনের নামে ব্যানার। ফাইল চিত্র।

শোভন চট্টোপাধ্যায় যে ওয়ার্ড থেকে জিতে কাউন্সিলর হয়েছিলেন, সেই ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব আগেই দেওয়া হয়েছিল। এ বার শোভনের বিধানসভা কেন্দ্র বেহালা পূর্বের দায়িত্বও পেলেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। ফলে ফের এক বার শোভন এ শহরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন। সে প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল, মাত্র কিছু দিন আগেই ব্যানার পড়েছিল কলকাতায়। প্রথমে দক্ষিণ কলকাতা। তার পরে বেহালায়। রহস্যে ঘেরা ব্যানার পড়ল দু’দফায়। আর ব্যানার-প্রচারের উদ্যোক্তারা যে হইচই চাইলেন, দু’বারই তা বেশ সশব্দে হল। বছর দেড়েক ধরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও কলকাতায় যে শোভন চট্টোপাধ্যায় এখনও খুবই প্রাসঙ্গিক, তা বেশ বোঝা গেল। কলকাতার বর্তমান মেয়রকেও সম্ভবত কিছুটা চাপে ফেলা গেল। কিন্তু এ সব করল কারা? শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নামে আচমকা এত ব্যানার ছাপিয়ে লাভটা কাদের হল? এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও অধরা।

Advertisement

দক্ষিণ কলকাতায় এবং বেহালায় শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ও বিজেপির প্রতীক সম্বলিত যে সব ব্যানার লাগানো হয়েছে, তাতে খুব কৌশলে মূলত তিনটে তত্ত্ব চাউর করার চেষ্টা হয়েছে। প্রথম তত্ত্ব— ফিরহাদ জমানায় কলকাতার পুর পরিষেবা নিম্মগামী এবং শোভন জমানার অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। দ্বিতীয় তত্ত্ব— কলকাতার জন্য সেরা মেয়র শোভনই। তৃতীয় তত্ত্ব— বিজেপির তরফ থেকে শোভন চট্টোপাধ্যায় সামনে আসুন এবং পুরভোট অভিযানের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন, যেটা কলকাতার নাগরিকরা চাইছেন।

পুরভোটের মুখে এই মাত্রায় শোভন-বন্দনা কারা করতে পারেন? এতে কাদের লাভ? ব্যানারের উৎসমুখ খুঁজে বার করতে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজতে হচ্ছে সর্বাগ্রে।

Advertisement

কলকাতার সাড়ে আট বছরের মেয়র তথা বেহালা পূর্বের বিধায়ক, শোভন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূল ছেড়ে দিয়েছেন। আর বিজেপিতে তিনি থেকেও নেই। অর্থাৎ কাগজে-কলমে একটা দল তাঁর থাকলেও বাস্তবে তিনি দলহীন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, এই রকম দলহীন অবস্থায় থাকার কারণে শোভনের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা দ্রুত কমছিল। কোনও না কোনও উপায়ে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়ে নেওয়া শোভনের নিজের পক্ষেই সব থেকে জরুরি ছিল। দক্ষিণ কলকাতা ও বেহালা জুড়ে শ’চারেক ব্যানার সেই কাজটাই করে দিল।

আরও পড়ুন: মেয়রের ঘরই দলীয় অফিস! দলবদল প্রশাসনিক ভবনে, বিতর্কে ফিরহাদ

অর্থাৎ শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেই এই ব্যানার-প্রচার চালিয়েছেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ওই অংশের মত। কিন্তু এ মত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। কারণ আপাতদৃষ্টিতে শোভনকে যতই অপ্রাসঙ্গিক মনে হোক, বাস্তব তা নয়। পুরভোটে শোভনকে সঙ্গে পেতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সক্রিয়। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে শোভনের যে মনান্তর হয়েছিল দেবশ্রী রায়ের পর্বকে ঘিরে, বিজেপি এখন সেই মনান্তরও মিটিয়ে ফেলতে চায়। তাই শোভনের নামে ব্যানার বিজেপি ছাপায়নি বলে জানিয়েও দিলীপ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কোনও স্থানীয় কর্মী এর মধ্যে থাকলেও থাকতে পারেন।’’ শোভনের ব্যানার দেখে বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ‘টেনশন হচ্ছে’ বলেও দিলীপ মন্তব্য করেছিলেন। অর্থাৎ দিলীপ বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, ব্যানারগুলো দেখে তিনি খুশিই হয়েছেন। শোভনের তরফ থেকে বিজেপি কোনও সাড়া পায়নি বলেই খবর। ১ মার্চ শহিদ মিনার ময়দানে অমিত শাহের সভায় হাজির থাকার অনুরোধ করে শোভন-বৈশাখীকে বার বার ফোন করা হয়েছিল বিজেপির তরফ থেকে। কিন্তু ব্যক্তিগত কাজে বাইরে থাকবেন বলে জানিয়ে শাহের সভাতেও শোভন গরহাজির থেকেছেন। ব্যানারের মাধ্যমে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসাই যদি শোভনের লক্ষ্য হয়, তা হলে তিনি অমিত শাহের সভা থেকে দূরে থাকবেন কেন? উঠছে এই প্রশ্ন।

তা হলে কি শোভনকে সক্রিয় করে তোলার জন্য বিজেপি-ই বেনামে ব্যানার ছাপাল? দিলীপ ঘোষ-সহ দলের গোটা রাজ্যে নেতৃত্ব আগেও বলছিলেন যে, এই ব্যানার বিজেপি ছাপায়নি। রাজ্য স্তরের আর এক নেতা শিশির বাজোরিয়া আরও ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘‘বিজেপি একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। এই দলে যা খুশি করা যায় না। কর্মীরা বা নেতৃত্ব কেউই এই রকম হঠকারী ভাবে ব্যানার ছাপাতে যাবেন না। কারণ বিজেপিতে এই পদ্ধতিতে কাজই হয় না। কেউ ব্যক্তিগত ভাবে নিজের নামে ব্যানার ছাপাতেই পারেন। কিন্তু ব্যানার বা হোর্ডিং দিয়ে দল কোনও প্রচারাভিযান যদি শুরু করতে চায়, তা হলে সেটা বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েই হয়। এ ভাবে গোপনে হয় না।’’

শোভন তা হলে কি নিজে ছাপালেন ব্যানারগুলো? শিশির বাজোরিয়া তা-ও মনে করছেন না। তাঁর ইঙ্গিত, এর নেপথ্যে রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। শিশিরের কথায়, ‘‘ফিরহাদ হাকিমকে তৃণমূলে অনেকেই পছন্দ করেন না। ফিরহাদ আবার মেয়র হন, এটা অনেকেই চান না। তাই এটা প্রচার করার একটা চেষ্টা হল যে, শোভন অনেক বেশি সফল মেয়র ছিলেন। ফিরহাদ ব্যর্থ। ফিরহাদের আমলে কলকাতা বেহাল।’’ ফিরহাদের আমলে কলকাতার পুর পরিষেবার মান নেমে গিয়েছে এটা বিজেপির নেতারা বলেই থাকেন। কিন্তু শিশিরের কথায়, ‘‘শুধু বিজেপি না, তৃণমূলের একটা অংশও পুর পরিষেবার মান নেমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে ফিরহাদকে ধাক্কা দিতে চায়। সে অংশই সম্ভবত শোভনকে শিখণ্ডী খাড়া করল।’’

কিন্তু তৃণমূল যদি ব্যানার ছাপায়, তা হলে ‘পদ্মফুল’ প্রতীক দিয়ে কেন ছাপাবে? শিশির বলছেন, ‘‘জোড়া ফুল দিয়ে ছাপানোর উপায় নেই, কারণ শোভন কাগজে-কলমে বিজেপিতে রয়েছেন। কোনও প্রতীক ছাড়াই ছাপানো যেত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তত্ত্ব আরও প্রকট হত। ‘পদ্মফুল’ দিয়ে ছাপানোর ফলে বিজেপির দিকে দায় ঠেলে দেওয়া গেল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।’’ শোভনের নামে দক্ষিণ কলকাতায় ব্যানার পড়ার পরের দিনই কী ভাবে উত্তর কলকাতায় ফিরহাদের সমর্থনে ব্যানার ঝোলানো হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন শিশির। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব স্পষ্ট ওতেই, দাবি তাঁর।

আরও পড়ুন: ‘রিবুট কলকাতা’ কি শহরকে পুনরুজ্জীবিত করার আড়ালে বিজেপির প্রচার কৌশল

তৃণমূল অবশ্য ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ তত্ত্ব সপাটে নস্যাৎ করছে। ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র হিসাবে সকলেই পছন্দ করছেন কি না, সে বিষয়ে তৃণমূলের কেউই প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি নন। কিন্তু ফিরহাদকে যদি কেউ চাপে ফেলতেও চান, তা হলে অন্য অনেক রাস্তা রয়েছে, শোভনের ছবি ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই— মত একাধিক কাউন্সিলরের। এ বারের পুরভোটে তৃণমূল জিতলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেয়র পদে বসানো হতে পারে, এ রকম একটা ফিসফাস কলকাতা পুরসভার অন্দরে কান পাতলে সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে। তাই তৃণমূলের যাঁরা ফিরহাদকে চান না, তাঁদের সামনে পথ খোলা রয়েছে অভিষেকের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ব্যানার ছাপানোর। সে ব্যানার কেউ ছাপালে পাল্টা ব্যানার ঝোলানোর সাহসও কোনও পক্ষের হবে না। সুতরাং শোভনের নামে ব্যানার তৃণমূলের কেউ ঝোলাতে যাবেন না বলে পুরনো কাউন্সিলরদের অনেকেই মনে করছেন।

তা হলে এই শোভন-বন্দনার নেপথ্যে কে? কলকাতার আর এক প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় মনে করছেন, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের শিবির থেকেই ব্যানার লাগানো হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘শোভনের আশেপাশে যারা থাকেন, যাঁরা ওর ঘনিষ্ঠ, তাঁরাই কিছু পয়সা খরচ করে ব্যানার ছাপিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন বলে আমার ধারণা।’’ সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে শোভন নিজেও রয়েছেন, এমনটা সুব্রত বলছেন না। তার ব্যাখ্যা, ‘‘শোভনের ঘনিষ্ঠরা চান যে, পুরসভার ভোটের আগে ওঁর গুরুত্ব বাড়ুক। সেই লক্ষ্যেই ব্যানারগুলো তাঁরা ছাপিয়েছেন, যাতে শোভনকে নিয়ে আবার একটা হইচই শুরু হয়। তৃণমূল তাড়াতাড়ি বলে যে, তুমি ফিরে এসো, তোমাকে আমাকে ভাল জায়গা দিচ্ছি। বিজেপিও তৎপর হয়ে ওঠে, তারাও বলে, তুমি কোথাও যেও না, তোমাকে সামনে রেখেই আমরা লড়ব।’’

শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজে এখনও এক বারের জন্যও মুখ খোলেননি ব্যানার পর্ব নিয়ে। তিনি মুখ খুললে কিছুটা স্পষ্ট হত ব্যান্যার প্রচারের নেপথ্যে আসলে কারা। শোভনের নীরবতা নানা তত্ত্বের জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক শিবিরে। আসল তত্ত্ব যাই হোক, দক্ষিণ কলকাতা আর বেহালা জুড়ে শ’চারেক ব্যানারের আবির্ভাব যে রকম হইচই ফেলল, তাতে এটা স্পষ্ট হল যে, কলকাতার পুরভোটে শোভন এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।

ঠিক সেই কারণেই কি আরও এক বার রত্না চট্টোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিকতা বেড়ে গেল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement