ধর্মতলার অনশনমঞ্চে জুনিয়র ডাক্তারেরা। — নিজস্ব চিত্র।
১০০ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে সপ্তমীর সকালেই। ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলের কাছে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন সাত জুনিয়র ডাক্তার। দাঁতে কাটছেন না কোনও খাবার। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের শব্দ তাঁদের কানে পৌঁছচ্ছে না। তাঁদের সামনে খাবারও খাচ্ছেন না সতীর্থ বা সহমর্মীদের কেউ। তবে সময় যত গড়াচ্ছে, তত দুর্বলতা গ্রাস করছে অনুষ্টুপ, সিগ্ধা, অনিকেতদের। কেউ মাথা তুলে আছেন এখনও। কেউ শুয়ে পড়েছেন। ১০০ ঘণ্টা না খেয়ে সম্ভবত খিদের বোধ চলে গিয়েছে তাঁদের!
খাবার খাচ্ছেন না, তবে জল খাচ্ছেন অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। শুধুই জল। অন্য কোনও তরলও নয়। তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যত ক্ষণ না সরকারের তরফে সাড়া পাচ্ছেন, যত ক্ষণ না ‘শুভবুদ্ধির উদয়’ দেখছেন, তত ক্ষণ জল ছাড়া কিছু খাবেন না। জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াতে, তাঁদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে প্রতীকী অনশন করছেন সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। বৃহস্পতিবারও সকাল ৯টা থেকে না খেয়ে বসে আছেন তাঁরা। অনশন চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। অনেক সাধারণ মানুষও অনশনকারীদের সমব্যথী হয়ে ধর্মতলায় জড়ো হচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা কী করছেন? তাঁদের সহকর্মী, সহযোদ্ধারাই বা কী করছেন?
অনশনকারীদের ওজন কমবেশি সকলেরই কমেছে। তাঁদের জন্য মঞ্চে ওষুধের বন্দোবস্ত রয়েছে। ডাক্তারেরা আছেন। সিপিআরের (প্রয়োজনে মুখে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেরানোর চেষ্টা) ব্যবস্থাও আছে। মাঝেমধ্যে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে ব্যথা শুরু হচ্ছে। তখন বাকিরা তাঁদের হাত-পা টিপে দিচ্ছেন। ওষুধ দিচ্ছেন প্রয়োজনমতো। অনশনকারীরা জানাচ্ছেন, সহযোদ্ধাদের সাহায্য ছাড়া তাঁরা মনের জোর পেতেন না। ধরে ধরে শৌচাগারে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘুমন্ত বন্ধুর পাশে রাত জাগা— যাঁরা অনশন করছেন না, তাঁরা সবসময় সক্রিয়। অনেকে সহকর্মীদের জন্য সমব্যথী হয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন কোনও কোনও দিন। সপ্তমীর সন্ধ্যা পর্যন্ত অনশনকারীরা মনের জোর ধরে রেখেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার তাঁদের ১০ দফা দাবি না মানলে অনশন উঠবে না! তার মধ্যেই অনশনমঞ্চে পৌঁছেছে পুলিশ। তারা অনশনকারীদের বলেছে, এলাকা খালি করে দিতে। অনুরোধ করেছে, ওই সাত জন যেন ‘চিকিৎসা সহায়তা’ গ্রহণ করেন।
দিনে দু’বার অনশনকারীদের রক্তচাপ, নাড়ির গতি, ক্যাপিলারি ব্লাড গ্লুকোজ (সিবিজি) পরিমাপ করা হচ্ছে। তাঁদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাত অনশনকারীর সঙ্গে কথা বলেছে আনন্দবাজার অনলাইন।
অর্ণব মুখোপাধ্যায়, পিডিটি প্রথম বর্ষ, এসএসকেএম
অর্ণবের কথায়, ‘‘শারীরিক ভাবে একটু তো দুর্বল লাগছেই। উঠতে গেলে হাল্কা মাথা ঘুরছে। বার বার জল খেতে হচ্ছে। তাতে খিদেটা একটু মেটানো যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য বার বার টয়লেটও ব্যবহার করতে হচ্ছে। মানসিক দিক থেকে শক্ত আছি। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’’
বৃহস্পতিবার সকালে অর্ণবের রক্তচাপ ছিল ১২৪/৮৬, নাড়ির গতি ১০৮ এবং সিবিজি ৬৮।
বৃহস্পতিবার অনশনমঞ্চে অর্ণব মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, পিডিটি প্রথম বর্ষ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
অনুষ্টুপের বক্তব্য, ‘‘যে অবস্থায় আমরা অনশন করতে এসেছিলাম, ১০০ শতাংশ তেমন পরিস্থিতি এখন নেই। ৮০-৯০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে আমরা এখনও স্থিতিশীল আছি। জল খাচ্ছি। বুধবার রাতে মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসু না হওয়ায় আমরা হতাশ। আশা করেছিলাম, বৈঠক থেকে সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে। তা তো হল না! মনে হচ্ছে, আমাদের অনশনকে খাটো করে দেখছে সরকার। এতে আমরা দুঃখিত, ক্ষুব্ধও। তবে ওই বৈঠকটার পর আমাদের প্রতিবাদের স্পৃহা আরও বেড়ে গিয়েছে। যত দিন না সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে, আমরা অনশন চালিয়ে যাব।’’
বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্টুপের রক্তচাপ ছিল ১২০/৮৬, নাড়ির গতি ৯০ এবং সিবিজি ৬৯।
বৃহস্পতিবার অনশনমঞ্চে অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
তনয়া পাঁজা, ইএনটি সিনিয়র রেসিডেন্ট, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
তনয়া বলছেন, ‘‘আমরণ অনশন যে কোনও প্রতিবাদের চূড়ান্ত স্তর। এত দূর আমাদের আসতে হল কেন? যে শারীরিক অবস্থায় আমরা এখানে এসেছিলাম, এখন তার থেকে কিছুটা দুর্বল হয়েছি ঠিকই। কিন্তু সকলেই মানসিক ভাবে শক্ত আছি। প্রশাসন এখনও কোনও সদিচ্ছা দেখায়নি, এটাই উদ্বেগের। কারও কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। আমরা যে এখনও হেঁটেচলে বেড়াচ্ছি, তার মূল কারণ আমাদের সহকর্মীদের সহযোগিতা। ওরা আমাদের জন্য যে পরিশ্রম করছে, তার কথা না বললেই নয়। অনেকেই আছে, যারা সারা দিন খাচ্ছে না। ওদের কথাও ভাবতে হবে।’’
বৃহস্পতিবার সকালে তনয়ার রক্তচাপ ছিল ১১৪/৯০, নাড়ির গতি ১০০ এবং সিবিজি ৭০।
অনশনমঞ্চে তনয়া পাঁজা। —নিজস্ব চিত্র।
পুলস্ত্য আচার্য, পিজিটি প্রথম বর্ষ, এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ
পুলস্ত্যের কথায়, ‘‘শরীরটা সামান্য দুর্বল লাগছে। তবে মানসিক ভাবে যে অবস্থায় শুরু করেছিলাম, তেমনই আছি। ভেঙে পড়ার কোনও প্রশ্ন নেই। আমাদের সামনে কেউ খাবারও খাচ্ছে না। না খেয়ে থাকাটা একেবারেই আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। বাইরের কিছুতে আমাদের যায়-আসে না। দুর্বল হয়েছি বলেই যে মনের জোর কমে গিয়েছে, তাও নয়।’’
বৃহস্পতিবার সকালে পুলস্ত্যর রক্তচাপ ছিল ১১০/৭০, নাড়ির গতি ৭২ এবং সিবিজি ৬৮।
অনশনমঞ্চে পুলস্ত্য আচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, পিজিটি তৃতীয় বর্ষ, কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ
অনশন মঞ্চে শুয়ে থাকায় সায়ন্তনীকে বিরক্ত করা হয়নি। তবে তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন, সায়ন্তনীর কিছুটা মাথাব্যথা রয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা থাকলেও মনের জোর কমেনি। তবে অনশনের ফলে চার কেজি ওজন কমে গিয়েছে তাঁর।
বৃহস্পতিবার সকালে সায়ন্তনীর রক্তচাপ ছিল ১০৬/৭৬, নাড়ির গতি ৭৩ এবং সিবিজি ৬৮।
অনশনমঞ্চে সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা। —নিজস্ব চিত্র।
স্নিগ্ধা হাজরা, সিনিয়র রেসিডেন্ট, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
স্নিগ্ধা অধিকাংশ সময়েই অনশন মঞ্চে বিশ্রামে রয়েছেন। তবে কখনও সখনও বন্ধুদের সঙ্গে সামান্য কথাবার্তা বলছেন। স্নিগ্ধা আগে গ্যাসট্রাইটিসে ভুগতেন। এই ধরনের রোগীদের খালি পেটে না থাকার পরামর্শই দেন ডাক্তারেরা। স্নিগ্ধার সেই কারণে পেটে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। চিকিৎসক অসীম মাইতি রিপোর্ট দেখে জানিয়েছেন, স্নিগ্ধার রক্তচাপ কম। কম রয়েছে সিবিজি-ও। সেটা উদ্বেগজনক। সিবিজি ৬০-এর নীচে নেমে গেলে কিডনিতে তার প্রভাব পড়তে পারে।
বৃহস্পতিবার সকালে স্নিগ্ধার রক্তচাপ ছিল ১০৪/৭৮, নাড়ির গতি ৮০ এবং সিবিজি ৬১।
অনিকেত মাহাতো, পিজিটি তৃতীয় বর্ষ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ
অনিকেত ঘুমন্ত থাকায় তাঁকে বিরক্ত করা হয়নি। বন্ধুরা জানাচ্ছেন, অনিকেতও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তবে মানসিক ভাবে শক্ত আছেন। আরজি করের চিকিৎসক সৈকত নিয়োগী জানান, রিপোর্ট অনুযায়ী অন্যদের চেয়ে অনিকেতের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে আইসিইউ-য়ে পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। তাঁর মূত্রে কিটোন বডি পাওয়া গিয়েছে বলেও জানিয়েছেন সৈকত।
বৃহস্পতিবার সকালে অনিকেতের রক্তচাপ ছিল ১২২/৯০, নাড়ির গতি ১০০ এবং সিবিজি ৮৩।
অনশন অবস্থানে উপস্থিত চিকিৎসকদের মতে, সাত অনশনকারীই এখনও পর্যন্ত শারীরিক ভাবে সামান্য দুর্বলতা ছাড়া হয়ত কিছু বোধ করছেন না। তবে রিপোর্ট বলছে, তাঁদের শারীরিক পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক’। অনশন চলিয়ে গেলে সেই পরিস্থিতির অবনতি হওয়াই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে সময়ও পাওয়া যাবে কম। সিনিয়র চিকিৎসকেরা প্রশাসনের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, অবিলম্বে সমাধান সূত্র বার করার জন্য যেন পদক্ষেপ করা হয়।