গণপরিবহণ বন্ধ হওয়ার ঘোষণার পরে ভিড়ের কথা না ভেবে বাড়ি ফেরার মরিয়া চেষ্টা। -নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যে গণ পরিবহণ বন্ধ রাখার সরকারি নির্দেশে আশঙ্কার মেঘ অসংগঠিত পরিবহণকর্মীদের মনে। অটো, ট্যাক্সি, অ্যাপ-ক্যাব চালকদের পাশাপাশি বেসরকারি বাস ও মিনিবাসের কর্মীদের মনেও ফিরে আসছে গত বছরের দীর্ঘ লকডাউনের দুঃসহ স্মৃতি। করোনাকে ঠেকাতে দেশজোড়া লকডাউন তাঁদের জীবন ও জীবিকায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। অধিকাংশ পরিবহণকর্মীকেই সংসার চালাতে বেছে নিতে হয়েছিল বিকল্প কোনও পেশা। অটো, ট্যাক্সি এবং বেসরকারি বাসকর্মীদের একাংশ পড়েছিলেন সব চেয়ে খারাপ অবস্থায়।
দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া-গোলপার্ক রুটের অটোচালক সমীর মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত) কথায়, ‘‘গত বছর লকডাউনের প্রথম দিকে জমানো টাকা ভেঙে সংসার চালিয়েছি। পরে শিয়ালদহ থেকে আনাজ এনে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে বিক্রি করতাম। তাতে রোজগার ভাল হত না। তখন স্ত্রী ও ছেলে মিলে পাউরুটি, দুধ আর স্যানিটাইজ়ারের দোকান দিয়েছিল।’’ সমীরের কলেজপড়ুয়া ছেলেকে তখন দিনের পর দিন পড়া ছেড়ে সকালে বাজারে বসতে হয়েছে। দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় চেনা-পরিচিতদের বাড়িতে আনাজ পৌঁছে দিতে হয়েছে সামান্য কিছু রোজগারের আশায়।
গত বছরের লকডাউনের সময়ে গড়িয়া-বারুইপুর রুটের অটোচালক রফিক সর্দার (নাম পরিবর্তিত) প্রথম দিকে কিছু দিন মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার বিক্রি করলেও পরে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতে বাধ্য হন। ভবানীপুরের বাসিন্দা, ট্যাক্সিচালক জিতেন ভগত নিয়েছিলেন নিরাপত্তারক্ষীর অস্থায়ী কাজ। বেসরকারি বাসের কর্মী, ক্যানিংয়ের বাসিন্দা শেখ মিরাজের কথায়, ‘‘বাস চললে দিনে তবু ৩০০-৪০০ টাকা মেলে। সব বন্ধ হয়ে গেলে খাবটা কী?’’
গত বছর লকডাউনের সময়ে বাসমালিকদের বেশ কিছু সংগঠন এগিয়ে এসে সাহায্য করেছিল। এ বার কী হবে, জানা নেই শেখ মিরাজের। তবে, আগের বারের চেয়ে এ বারের করোনা পরিস্থিতি যে অনেক বেশি ভয়াবহ, সে কথা মানছেন সকলেই। সমীরের কথায়, ‘‘আগের বার চেনা-পরিচিত অনেকেই সাহায্য করেছিলেন। এ বার তো তাঁদের মধ্যেই তিন জনকে হারিয়েছি। ফলে, কী হবে, জানি না।’’ রফিক ও জিতেনের মতে, ‘‘নেতারাই তো মিটিং-মিছিল করে করোনাকে ডেকে আনলেন। এখন পরিস্থিতি সামলাতে আমাদের খেসারত দিতে হচ্ছে।’’
আতঙ্কে আছেন অ্যাপ-ক্যাব চালকেরাও। গত বছরের লকডাউনে রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ির ঋণের কিস্তি মেটাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন তাঁদের অনেকেই। বাগুইআটির এক ক্যাবচালক ঋণের কিস্তি মেটাতে না পেরে আত্মহত্যাও করেন।
এ দিকে, নিউ টাউন, রাজারহাট, গোপালপুর এলাকার কয়েক হাজার অটোচালকও প্রবল দুশ্চিন্তায়। গত বছর লকডাউনে তাঁদের কেউ আনাজ বিক্রি করেছেন, কেউ বা করেছেন রাজমিস্ত্রির কাজ। এ বারেও তেমনই কিছু বিকল্প বেছে নিতে হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। বিধাননগরের বিধায়ক তথা দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু দাবি করেছেন, অটোচালকদের সঙ্কটে যথাসাধ্য পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন তাঁরা।
এ দিকে, আইএনটিটিইউসি-র উত্তর কলকাতা জেলা অটো ইউনিয়নের নেতা অশোক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেন্দ্র প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করল না। অথচ, মিটিং-মিছিল করে রোগ ছড়ালেন নেতারা। এখন তো করোনা ঠেকাতে কড়াকড়ি ছাড়া উপায়ও নেই। তবে, আমরা সাধ্য মতো চালকদের পাশে থাকব।’’ এআইটিইউসি-র অ্যাপ-ক্যাব সংগঠনের নেতা নওলকিশোর শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘আমরা পরিবহণ দফতরের আঞ্চলিক অধিকর্তাকে চিঠি দিয়েছি, যাতে এই অবস্থায় ব্যাঙ্কগুলিকে অন্তত ছ’মাসের জন্য কিস্তি মকুব করতে বলা হয়। অন্যান্য কর এবং বিমার কিস্তিতেও ছাড় দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে ওই খরচ মেটাতে হলে চালকেরা তো না খেয়ে মরবেন।’’