গাদাগাদি: বাগবাজারে নিবেদিতা উদ্যানে ত্রিপলের ছাউনির নীচে এ ভাবেই দিন কাটছে হাজার বস্তির বাসিন্দাদের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সাত মাস আগের এক সন্ধ্যায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তাঁদের সর্বস্ব। বিধ্বংসী আগুনে চোখের সামনেই সব কিছু শেষ হয়ে যেতে দেখেছিলেন নিমেষে। তার পর থেকে মাথা গোঁজার আশ্রয় বলতে পাশের উদ্যানে লম্বা ত্রিপলের ছাউনি। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি— সবেতেই এখনও ত্রিপলের ছাউনিই ভরসা বাগবাজারের হাজার বস্তির বাসিন্দাদের।
গত ১৩ জানুয়ারির সেই ভয়াবহ সন্ধ্যায় পুড়ে গিয়েছিল হাজার বস্তির ১০৬টি ঘর। সর্বহারা হয়েছিলেন প্রায় সাড়ে সাতশো বাসিন্দা। তার পরে আশ্রয় মিলেছে বস্তি থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে বাগবাজারের নিবেদিতা উদ্যানের শিবিরে। সেখানে হলঘরের মতো তিনটি বড় এবং দু’টি ছোট ছাউনিতে প্রায় দেড়শো শিশু-সহ বসবাস ‘ঘরপোড়া’ পরিবারগুলির। এক একটি ত্রিপলের নীচে গাদাগাদি করেই থাকছে প্রায় ৩০-৪০টি পরিবার। করোনাকালেও ভিড়ে ঠাসা ওই উদ্যানে দূরত্ব-বিধি মেনে চলার বালাই নেই, উপায়ও নেই।
ছেলে-বৌমা, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ওই উদ্যানে পুরসভার তৈরি অস্থায়ী ছাউনিতে মাথা গুঁজতে হয়েছিল হাজার বস্তির বাসিন্দা সারথি মণ্ডলকে। তাঁর কথায়, ‘‘শুনছি ফের করোনা আসছে। এ বার নাকি বাচ্চাদের বেশি ভোগাবে। অথচ আমরা যে ভাবে গাদাগাদি করে এখানে থাকছি, তাতে তো ভয় হচ্ছেই।’’ শিবিরে ঠাঁই পাওয়া অনেক বয়স্ক প্রতিষেধক নিয়েছেন। তবে অনেকের এখনও দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়া বাকি। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, উদ্যানটি হাজার বস্তির বাসিন্দাদের আশ্রয় শিবিরে পরিণত হয়েছে। উদ্যানে শিবিরের পাশেই কুমড়ো, পুঁইশাকের গাছ লাগিয়েছেন তাঁরা। বয়স্কদের কেউ কেউ উদ্যানের মাঠে খোলা রোদে চাল বাছতে ব্যস্ত। মাঠ জুড়ে খেলছে ছোটরা। মহিলাদের অনেকেই বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। সারথিদেবীর অভিযোগ, ‘‘বেশি বৃষ্টি হলে ত্রিপলের ভিতরে জল ঢুকে যায়। আবার ত্রিপলে ফুটো থাকলে উপর থেকেও বৃষ্টির জল পড়ে।’’
আর এক বাসিন্দা সারথি মাইতির অভিযোগ, ‘‘প্রচুর মশা এখানে। কয়েক জনের জ্বরও হয়েছে।’’ যদিও পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর বাপি ঘোষ এই অভিযোগ নস্যাৎ করে বলছেন, ‘‘ওঁরা ঠিক বলছেন না। মশা দূর করতে সপ্তাহে তিন দিন পুরসভার তরফে ওই অস্থায়ী শিবিরে মশা মারার তেল স্প্রে করা হয়। পর্যাপ্ত আলো-পাখার ব্যবস্থাও রয়েছে।’’
তবে উদ্যানের শিবিরে ঠাঁই পাওয়া বেশির ভাগ বাসিন্দাই চাইছেন পুরনো ঠিকানায় ফিরে যেতে। শিবিরে চার সদস্যদের পরিবারকে নিয়ে মাথা গোঁজা, পেশায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে তারক জাগুলিয়া বলছেন, ‘‘হাজার বস্তিতে পুরসভা আমাদের বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু কাজ খুব ধীর গতিতে হচ্ছে। আমরা চাই, দ্রুত কাজ শেষ হোক। তা হলে এখান থেকে আমরা যেতে পারব।’’
বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, বিধানসভা ভোটের আগে পুরসভার তরফে তাঁদের এক বেলা করে খাবার দেওয়া হলেও ভোটের পর থেকে সে সবই বন্ধ। যদিও স্থানীয় কোঅর্ডিনেটরের দাবি, ভোটের আগে নির্বাচনী বিধি চালু হয়ে যাওয়ায় খাবার দেওয়া বন্ধ করা হয়েছিল। ভোটের পরে শিবিরবাসীরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁদের আর খাবার দিতে হবে না।
তবে দগ্ধ হাজার বস্তিতে নতুন করে পাকা বাড়ি তৈরির কাজ জোরকদমেই চলছে বলে জানাচ্ছেন বাপিবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘২৩ জানুয়ারি আগুন লাগার পরে ফেব্রুয়ারি থেকেই ১৪ কাঠা জায়গার উপরে তিনতলা বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই বাড়ির দোতলা প্রায় শেষের মুখে। সেখানে প্রতিটি পরিবার তিনটি করে ঘর পাবেন। আশা করছি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নিবেদিতা উদ্যান থেকে ওঁদের এখানে আশ্রয় দিতে পারব।’’ কলকাতা পুরসভার বস্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য স্বপন সমাদ্দার বলেন, ‘‘বস্তিবাসীদের কষ্টটা বুঝছি। আগুন লাগার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা নতুন করে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি, শীঘ্রই ওই কাজ শেষ হয়ে যাবে।’’