জনস্রোত: রবিবার আলিপুর চিড়িয়াখানার সামনে ভিড়ের জেরে থমকে যানবাহন। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
শীতের উৎসবে প্রতি বার জওহরলাল নেহরু রোড এবং পার্ক স্ট্রিট সংযোগস্থলের কাছে একটি বহুতল অফিস ভবনের নীচের অংশ কয়েক দিনের জন্য ভাড়া নেয় পুলিশ। উৎসবের এই সময়ে ওই রাস্তায় ট্র্যাফিক বিধি ভঙ্গ করলেই চালককে নামিয়ে তাঁর গাড়ি অথবা মোটরবাইক নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বহুতলের ওই ফাঁকা জায়গায়। পরের দিন গাড়ির কাগজ ও লাইসেন্স এনে আইনি পদক্ষেপ মেনে বাইক ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয় চালককে। এমন ধরপাকড় বাড়ে বর্ষশেষের রাত ও বর্ষবরণের দিনে। কোনও কোনও বার বাজেয়াপ্ত হওয়া গাড়ি এবং মোটরবাইকের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায় বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
চলতি বছরেও কি এমন দৃশ্য দেখা যাবে? বড়দিনের আগে থেকে এই প্রশ্ন ঘুরছে বাহিনীর অন্দরে। এর মূলে রয়েছে সম্প্রতি চালু হওয়া একটি নিয়ম। জানা যাচ্ছে, এ বার ২৪ এবং ২৫ ডিসেম্বর পুলিশি তৎপরতায় পাঁচশোরও বেশি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও গাড়ি বা মোটরবাইক বাজেয়াপ্ত অথবা গ্রেফতারি তেমন হয়নি। এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘গাড়ি, মোটরবাইক বাজেয়াপ্ত বা গ্রেফতারি হবে কী করে? এখন ব্যক্তিগত বন্ডে থানা থেকেই জামিন দেওয়ার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। আইনজীবীর সাহায্যও লাগছে না। পরে আদালতে গিয়ে হাজিরা দেওয়ার শর্তে থানা থেকেই জামিন পাচ্ছেন বিধিভঙ্গকারীরা। বাজেয়াপ্ত হওয়া গাড়ি বা মোটরবাইকও ছেড়ে দিতে হচ্ছে বিধিভঙ্গকারীর কোনও পরিচিত, যিনি সুস্থ এবং লাইসেন্স আছে, এমন কারও হাতে!’’ এ-ও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ‘‘এই সুযোগে মত্ত অবস্থায় ফের গাড়ি বা মোটরবাইক চালিয়ে বিপদ ঘটালে কী হবে?’’
পুলিশি সূত্রের খবর, বড়দিনের আগের রাতে হেলমেট না থাকায় ৫৭ জন বাইকচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি মোটরবাইকে দু’জনের বেশি সওয়ারি থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৪৫টি ক্ষেত্রে। মাত্রাতিরিক্ত গতি এবং মত্ত অবস্থায় গাড়ি, মোটরবাইক চালানোয় পদক্ষেপ করা হয়েছে যথাক্রমে ৮৪ এবং ৭৮টি ক্ষেত্রে। অন্যান্য কারণে পদক্ষেপ করা হয়েছে ৫৯টি ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৩২৩টি ক্ষেত্রে। রাত পর্যন্ত পাওয়া পুলিশি তথ্য অনুযায়ী, এমন আরও ৩৫০টি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বড়দিনেও।
আগের নিয়ম অনুযায়ী, বিধিভঙ্গকারী চালককে গাড়ি বা মোটরবাইক-সহ স্থানীয় থানার হাতে তুলে দিতেন ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীরা। সেখান থেকে তাঁকে আইনজীবী মারফত জামিন নিতে হত। গাড়ি বা মোটরবাইক জমা থাকত থানায়। এর পরে আদালত ঘুরে আইনি পদক্ষেপ মেনে কাগজপত্র নিয়ে এলে তবেই ছাড়া হত গাড়ি বা মোটরবাইক। মত্ত অবস্থায় ধরা পড়লে পুলিশ মোটর ভেহিক্লস আইনের ১৮৫ ধারায় ব্যবস্থা নিতে পারে। চালকের ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার পরীক্ষা করিয়ে সেই রিপোর্টে চালককে দিয়ে সই করিয়ে তাঁকে থানার হাতে তুলে দিতেন পুলিশকর্মীরা। বাজেয়াপ্ত করা হত গাড়িটিও। এর পরে কোনও সরকারি হাসপাতাল থেকে চালকের শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে, মত্ত থাকার নিশ্চিত প্রমাণ নিয়েই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত থানা। এ ক্ষেত্রেও আইনজীবী মারফত জামিন নিতে হত।
কিন্তু এই ব্যবস্থাতেও প্রশ্ন উঠছিল। মুম্বইয়ে যেখানে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়লে জরিমানা, লাইসেন্স খারিজের পাশাপাশি হাজতবাসের পথও রয়েছে, সেখানে কলকাতায় শুধু জরিমানা দিয়েই বহু ক্ষেত্রে মিলছিল ‘মুক্তি’। কিছু ক্ষেত্রে লালবাজার তিন মাসের জন্য লাইসেন্স খারিজের দাবি করলেও ট্র্যাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের (এসি) মুখোমুখি হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি সাজাতে পারলে সেই ‘শাস্তিও’ সহজেই এড়ানো যেত বলে অভিযোগ। ফলে প্রশ্ন উঠছিল, ‘নরম’ সাজার কারণেই কি কমছে না মত্ত চালকদের দাপট?
কিন্তু নতুন নিয়মে বিধিভঙ্গকারীরা আরও সহজে ছাড় পেয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা পুলিশকর্মীদের একটা বড় অংশেরই। এখন লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে আঞ্চলিক পরিবহণ অধিকর্তার (আরটিও)। পুলিশ শুধু লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করতে পারে। তা হলে উপায়? লালবাজারের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘আইনজীবী মারফত জামিন নেওয়ার বিষয়ে বহু অভিযোগ উঠছিল। থানা থেকে চেনা আইনজীবীকে দিয়ে কাজ করাতে হবে বলে চাপ দেওয়ার অভিযোগও করেছিলেন অনেকে। তাই এই নতুন পদক্ষেপ। এতে পুলিশের আর দায় থাকবে না।’’
কিন্তু এই দায় এড়াতে গিয়ে বিপদ বাড়বে না তো? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি পুলিশ-প্রশাসনের থেকে।