Howrah Bridge

‘জরিমানা স্রেফ ১০ থেকে ৫০ টাকা, এত কমে হুঁশ ফেরে?’

২০১৯ সালে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল তিন হাজারেরও বেশি। মৃত্যু হয় প্রায় ২৫০ জনের।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২১ ০৫:০৬
Share:

হাওড়া সেতুতে ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে দিয়েই রাস্তা পেরোনোর চেষ্টা। ছবি দীপঙ্কর মজুমদার

ব্যস্ত সময়ে হাওড়া সেতু দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটছে একের পর এক গাড়ি। সেখানেই একটি বাসের গতি একটু কমতেই লাফিয়ে নেমে এলেন এক মহিলা। হাতে ধরা চটের ব্যাগ। বাসের পিছনে আসা গাড়ি কোনও মতে ব্রেক কষে সামলে নিল। এর পরে কোনও দিকে না তাকিয়েই মহিলা উল্টো পারের বাস ধরবেন বলে হাত দেখাতে দেখাতে ছুটতে শুরু করলেন! তবে বাসে ওঠা আর হল না। সেতুর মাঝামাঝি জায়গায় তাঁকে পিষে বেরিয়ে গেল একটি গাড়ি! পড়ে রইল রক্তাক্ত চটের ব্যাগ।

Advertisement

আদালতে শুনানির সময়ে দুর্ঘটনার এই ভিডিয়ো দেখিয়ে প্রশ্ন উঠল, হাওড়া সেতুর মাঝখান দিয়ে কি এ ভাবে রাস্তা পারাপার করা যায়? দোষ কার? যিনি ট্র্যাফিক-বিধি উড়িয়ে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন তাঁর, না কি গাড়িচালকের?

গত কয়েক বছরে গোটা দেশের মতো এ শহরেও এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা দেশের মতো এ শহরেও সব চেয়ে বেশি পথ দুর্ঘটনা ঘটে বিধি উড়িয়ে রাস্তা পারাপারের জেরে। কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল তিন হাজারেরও বেশি। মৃত্যু হয় প্রায় ২৫০ জনের। ২০২০ সালের অনেকটা সময় লকডাউন চললেও দুর্ঘটনার সংখ্যা বিশেষ কমেনি। মার্চের আগেই ঘটেছিল প্রায় ৯০০টি দুর্ঘটনা। আনলক-পর্বে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দুর্ঘটনাও বেড়েছে। গোটা বছরে বেপরোয়া ভাবে রাস্তা পেরোতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২১৬ জনের। বছরের চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি হলে সংখ্যাটি বাড়তে পারে।

Advertisement

পুলিশ জানাচ্ছে, বিভিন্ন সেতুর উপরে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। সাধারণত, সেতুর শুরু বা শেষে হাম্প থাকলেও মাঝে থাকে না। সেখানে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে সেতুর উপরে এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে গিয়ে কেউ গাড়ির সামনে চলে এলে বিপদ ঘটতে বাধ্য! এই চিত্রই ধরা পড়ে শহরের একাধিক সেতুতে। যেখানে রেলিং দিয়ে ফুটপাত ঘিরেও পথচারীদের রাস্তায় নেমে আসা আটকানো যায়নি। বন্ধ হয়নি একের পর এক মৃত্যু ঘটানো ‘জে ওয়াক’ (ট্র্যাফিক-বিধি উড়িয়ে শহরের পথে বেপরোয়া হাঁটাচলা)।

হাওড়া সেতুই যেমন। সেখানে হেঁটে সেতু পেরোনোর জন্য ফুটপাত রয়েছে। কিন্তু সেতুর এক ফুটপাত থেকে অন্য ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া নিষিদ্ধ। একাধিক দুর্ঘটনার পরে ফুটপাত ঘিরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে কোনও দিন সেখানে কিছু ক্ষণ দাঁড়ালেই দেখা যায়, বেপরোয়া পারাপারের চিত্র। একাধিক জায়গায় রেলিং ভেঙে রাস্তা বার করা হয়েছে। অনেকেই সেতুর মাঝখান দিয়ে ছুটছেন স্রেফ হাত দেখিয়ে গাড়ি থামানোর জোরে! মাথায় ভারী বস্তা নিয়ে কিছু ব্যক্তির সেতু পার হয়ে পোস্তার দিকে যাওয়ারও ওই একই পদ্ধতি। এর জেরে গাড়ির গতি তো কমছেই, দুর্ঘটনাও ঘটছে যখন-তখন। অভিযোগ, তবু পুলিশি প্রহরা বাড়ে না। সেতু ঘিরে স্রেফ সিসি ক্যামেরার নজরদারিই ভরসা!

একই অবস্থা শিয়ালদহ উড়ালপুলেও। সেখানেও বিধি উড়িয়ে দেদার সেতু পারাপার চলছে। এক দুপুরে দেখা গেল, সেতুর মাঝেই হঠাৎ থেমে যাওয়া বাস থেকে বড় তিনটে বস্তা নামালেন এক ব্যক্তি। একটি গাড়ি সরাসরি ধাক্কা মারল বস্তায়। চালক বললেন, “ভাবতেই পারিনি এ ভাবে বস্তা নামবে। ধাক্কা মেরে পিষে দিলে তো গাড়িচালককে পুলিশ জেল খাটাবে। এঁদের অবস্থা দেখার লোক কই?” নিরাপত্তার জোর বন্দোবস্ত থাকা মা উড়ালপুলে আবার দেখা গেল, দ্রুত গতিতে আসা একটি গাড়ি আপৎকালীন আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে গেল এক পাশে। গাড়ি থেকে নেমে এক তরুণী উড়ালপুলের এক দিক থেকে আর এক দিকে ছুটলেন পড়ন্ত বিকেলের ছবি তুলতে! গাড়ি পিষে দিলে কী হত? তরুণীর উত্তর, “ও কিছু হবে না। পুলিশ নেই দেখেই নেমেছি। ধরলেও তো তেমন কিছু বলে না শুনেছি। আমার বন্ধুরাই তো সেতুর উপর থেকে কত ছবি তুলেছে!”

পুলিশের আধিকারিকেরাও মানলেন মামলার তেমন কোনও ব্যবস্থা না থাকার কথা। লালবাজারের ট্র্যাফিক বিভাগের এক কর্তার কথায়, “এ ক্ষেত্রে জেওয়াকিংয়ের মামলা করা যায়। তবে অন্য কোনও ধারা নেই। মামলা করতে হয় কলকাতা পুলিশ আইনের ৬৬ নম্বর ধারায়। জরিমানা স্রেফ ১০ থেকে ৫০ টাকা, এত কম জরিমানায় কারও হুঁশ ফেরে?” দক্ষিণ কলকাতার ট্র্যাফিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক আবার বললেন, “এই জরিমানা বা মামলাতেও অনেক ঝামেলা। আগে মাইকে ঘোষণা করে পথচারীদের সতর্ক করতে হবে। তাতেও সতর্ক না হলে মামলা বা জরিমানা হবে!”

তা হলে উপায়? উত্তর নেই। পুলিশের বড় কর্তারাও জানাচ্ছেন, নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো আর সেতুর ধারের ফুটপাত যতটা সম্ভব ঘিরে দেওয়াই সম্বল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement