লকডাউন। গত দু’মাসে কলকাতা তার গায়ে মেখেছে এক অন্য অভিজ্ঞতা। সে সব কথাই আমরা তুলে ধরেছি পাঠকের সামনে। এ বার তুলে ধরছি কয়েক জন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোটোগ্রাফারের কথা। যে কথা বলেছে তাঁদের লেন্স। এঁদের কাজ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। ফোটোগ্রাফার হিসাবে এঁরা কেউই সুন্দরের পূজারী নন, বরং প্রকৃতি ও জীবনের অন্ধকারকেই টেনেহেঁচড়ে আমাদের মুখোমুখি করেন।
এ যেন ভিজুয়াল ও ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে জীবনের সব ওঠানামাকে ধরতে চাওয়া। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় সংবাদপত্রে একটি ক্যামেরার ছবি দেখে জিনিসটার প্রতি প্রথম আগ্রহ জন্মায় ফোটোগ্রাফার স্বস্তিক পালের। পরে কলেজে যাওয়ার পর ছবির প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে মা বেশ কষ্ট করেই একটি দামি ক্যামেরা কিনে দেন তাঁকে।
কলেজে পৌঁছে নতুন ক্যামেরা পেয়ে ছবির সঙ্গে নিবিড় সখ্য আরও গাঢ় হয় স্বস্তিকের। দেশ-বিদেশের ফোটোগ্রাফারদের ছবি, তাঁদের ছবি নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে ভিজুয়ালের প্রতি আরও ঝোঁক চেপে বসে। যাদবপুরে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনার সময় সেই নেশাকে পেশা করে নেওয়ার দিকে এগোন স্বস্তিক।
ফোটোগ্রাফি নিয়ে আরও পড়াশোনার সুযোগ পান এশিয়ান সেন্টার ফর জার্নালিজমে। স্কলারশিপ নিয়ে সেখান থেকে পাশ করে সিনেমা তৈরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন স্বস্তিক। ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে গেঁথে একটা গোটা গল্প তৈরির পাঠ তত দিনে নিজেই নিজেকে দিয়েছেন।
কর্মসূত্রে পুণেতে থাকলেও এই লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন কলকাতায়। ক্যামেরাও ছিল না সঙ্গে। তাতে কী? শিল্পীর মন আর ছবির বিষয় মিলে গেলে দৃশ্য তো তৈরি হবেই। কাজেই মোবাইলের ক্যামেরায় ভরসা করেই উঠল এ সব ছবি।
এর আগে সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে করে স্বস্তিকের বিশেষ একটি প্রজেক্ট ‘দ্য হাংরি টাইড’ আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি পায়। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই স্বস্তিকের এই কাজ মুগ্ধ করে সমালোচকদেরও। ‘ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’-র তরফে ন্যাশনাল মিডিয়া ফোটোগ্রাফি ফেলোশিপ পান এই কাজের জন্য। ফোটো ফাউন্ডেশনের সেরা এডুকেশন প্রোগ্রাম জুপ সোয়ার্ট ওয়ার্ল্ড প্রেস মাস্টারক্লাসের জন্য তিন বার নির্বাচিত হয়েছেন স্বস্তিক। আজও ছবির ভিতরের ছবিকে খুঁজতে চেয়েই ক্যামেরা ধরেন এই ফোটোগ্রাফার।
স্বস্তিক যদি ভিজুয়ালে আনন্দ পান, তবে জীবনের রোজনামচার মধ্যেই ছবিকে ধরতে চান এই শহরের আর এক ফোটোগ্রাফার অনিন্দ্য চক্রবর্তী। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন তিনি।
নিজের কাজে নিজেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন অনিন্দ্য। দেশ-বিদেশের নানা প্রকাশনায় তাঁর তোলা ছবি ইতিমধ্যেই ঠাঁই পেয়েছে। তসবির, আর্টস ইলাস্ট্রেটেড-ইন্ডিয়া, এফ স্টপ, একুয়েটর, আইপিএ— কী নেই সে তালিকায়! কলকাতার সিয়াগুল, বিড়লা অ্যাকাডেমি তো বটেই, ডাক পেয়েছেন নিউ ইয়র্কের এগ্জিট আর্ট গ্যালারি থেকেও।
এই লকডাউনের সময় যে হেতু বাড়িতে থাকা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাই চোখে পড়ে এমন অনেক ঘটনা যা, বাড়িতে না থাকলে দেখাই হত না সে ভাবে। অমনি সে সব লেন্সবন্দি করা শুরু। মেয়ের অনলাইন ক্লাস থেকে শুরু করে বিনুনির বাহার, স্ত্রী-কন্যার শরীরচর্চা সবই ধরা পড়ল ক্যামেরার চোখে।
কোনও কালে ছবির কোনও প্রশিক্ষণ না-নেওয়া অনিন্দ্য মনে করেন, জীবনই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। লকডাউনেও তাই জীবন খুঁজে বেড়ালেন ক্যামেরায়।
২৪ বছর বয়সে বেতনের টাকা জমিয়ে একটি ক্যামেরা কেনেন অনিন্দ্য। তার পর ধীরে ধীরে সখের ছবি তোলা হয়ে ওঠে নেশার যাপন।
অনিন্দ্য যখন জীবনের খোঁজ চালান, নীলার্ঘ তখন খৌঁজেন অস্তিত্বকে। অস্তিত্বের খোঁজ। ভারী ভারী শব্দ। তবে এই ভারী বিষয়কেই লহমায় সহজ করে তুলতে লেন্সে চোখ রেখেছেন তিনি।
কোনও সবুজ মাঠে একা কোনও বেঞ্চ হোক বা ছাদে নানা বাড়ির মাঝে ফুটকির মতো একটা মানুষ— এই ছোট ছোট অস্তিত্বগুলোকেই লকডাউনের সময় লেন্সে ধরেন কলকাতার ফোটোগ্রাফার নীলার্ঘ চট্টোপাধ্যায়।
ছবি তোলার সাধ ছোটবেলা থেকেই। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়লেও ক্যামেরার সঙ্গে সখ্য তৈরি হতে সময় লাগেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে সেই শখের গোড়াতেও জল দেওয়া। তখনও হাতে অত দামি ক্যামেরা আসেনি। কিন্তু তা দিয়েই পছন্দের দৃশ্যকে নীলার্ঘ বেঁধে ফেলতেন লেন্সে।
বেশ অল্প বয়স থেকেই ছবির জগতে নামডাক হতে শুরু করে নীলার্ঘের। দেশ-বিদেশের নানা ডকুমেন্টারি ছবির জন্য ২০১৮-তে ‘আলকাজি ফাউন্ডেশন ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফি গ্রান্ট’-এর তালিকাভুক্ত হন।
খ্যাতির সঙ্গে সম্মানও এই বয়সে কম পাননি নীলার্ঘ। ‘প্রিক্স পিকেট অ্যাওয়ার্ড’-এর অনূর্ধ্ব ৩০ বিভাগে নির্বাচিতও হন তিনি। নিউ ইয়র্কের আইসিপি মিউজিয়াম, মিয়ামি-সহ নানা শহরে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। ছবির মধ্যে দিয়েই নিজের অস্তিত্বের শিকড়েও টান মারতে চান এই ফোটোগ্রাফার।