‘অন্ধকার মহাদেশে’ পা রাখল ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। সেখানকার জনজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছে সে। সাহারা-কালাহারির গরম বালিতে পুড়ছে তার পিঠ। নীল নদের জলে সারছে স্নান। পাশাপাশি চলছে তার আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া এবং চিন-বিরোধী প্রচার। আর এর মধ্যে দিয়েই ‘রোগগ্রস্ত’ শরীরে অনেক দিনের পুরনো ইচ্ছা পূরণ করতে আস্তিনে লুকোনো তাস একটা একটা করে বার করছে সে।
আমেরিকা এবং চিনের পর এ বার তুরস্কের নজরে আফ্রিকা। সেখানকার ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যে বিবাদ মেটাতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বড় ভূমিকা পালন করায় খবরের শিরোনামে চলে এসেছে আঙ্কারা। শুধু তা-ই নয়, এতে ‘অন্ধকার মহাদেশে’ পায়ের তলার জমি যে অনেকটাই ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ শক্ত করে ফেলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
জমি দিয়ে ঘেরা ইথিওপিয়ার প্রয়োজন ছিল সামুদ্রিক পথের। তুরস্কের মধ্যস্থতায় সোমালিয়ার সঙ্গে সেই সংক্রান্ত চুক্তি সেরে ফেলেছে উত্তর আফ্রিকার এই দেশ। বিনিময়ে সোমালিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইথিওপিয়া। পাশাপাশি, সোমালিয়া ভেঙে সোমালিল্যান্ড তৈরির বিষয়টিকে আর সমর্থন করছে না আদ্দিস আবাবা। আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে একে আঙ্কারার মাস্টারস্ট্রোক হিসাবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর উত্তর অংশে বহু দশকের পুরনো ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যে ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ককে মধ্যস্থতার মাধ্যমে চিরতরে বন্ধুত্বে বদলে দিতে সফল হয়েছে তুরস্ক। এতে ওই এলাকায় এসেছে আঞ্চলিক স্থিরতা। তবে আঙ্কারার এই ‘আফ্রিকা প্রেম’ সাম্প্রতিক সময়ে উথলে উঠেছে, তা ভাবলে ভুল হবে। গত শতাব্দীর ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকেই ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর দিকে কড়া নজর রাখা শুরু করে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’।
২০০২ সালে তুরস্কে ক্ষমতায় আসেন রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘আফ্রিকা নীতি’কে আরও গতিশীল করে আঙ্কারা। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, পশ্চিমি দুনিয়ার প্রতি মোহভঙ্গ হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এর্ডোগান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ) তুরস্কের প্রবেশ আটকে যাওয়াকেও ভাল চোখে দেখেননি তিনি।
আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন এর্ডোগান। সেটি হল, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ‘শূন্য সমস্যা’। পাশাপাশি, সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন এলাকায় কূটনৈতিক এবং আর্থিক সম্পর্ক মজুবত করার দিকেও নজর রয়েছে তাঁর। সেখানে ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে আঙ্কারা। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে তুরস্ক নেতৃত্বাধীন অটোমান সাম্রাজ্যের উপকণ্ঠেই ছিল উত্তর আফ্রিকার এই সাহারা মরুভূমির এলাকা।
১৯৯৮ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে ‘আফ্রিকা অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রকাশ করে আঙ্কারা। এর পর থেকেই ‘অন্ধকার মহাদেশে’ তুরস্কের আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী কালে এতে হাওয়া দেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান।
২০০৫ সালে ‘আফ্রিকার জন্য উন্মুক্তকরণ’ নীতি নিয়ে আসেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। ওই বছরই আফ্রিকান ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক সদস্য পদ পায় আঙ্কারা। এর পর সেখানকার দেশগুলির মন জিততে একে ‘আফ্রিকার বছর’ বলে ঘোষণা করতে দেরি করেননি এর্ডোগান। অচিরেই কাজে আসে তাঁর কূটনৈতিক চাল। ২০০৮ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তুরস্ক।
আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকেই ‘অন্ধকার মহাদেশে’ তুরস্কের বাণিজ্যের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। ২০২৩ সালে সেটি ৪,০৭০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছয়। অথচ ২০০৩ সালে আফ্রিকা এবং আঙ্কারার মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩৫ কোটি ডলার।
সরকারি তথ্য বলছে, আফ্রিকায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় লগ্নি করেছে তুরস্কের নির্মাণকারী সংস্থা ‘টার্কিস কোঅপারেশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন এজেন্সি’ (টিআইকেএ)। ২০২৩ সালে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭,৭৮০ কোটি ডলার। পাশাপাশি, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের বরাত পেয়েছে আঙ্কারার আরও দুই নির্মাণ সংস্থা ‘ইয়াপি মেরকেজি’ এবং ‘সুম্মা’। তানজানিয়া এবং উগান্ডায় রেললাইন, নিরক্ষীয় গিনিতে সংসদ ভবন এবং সোমালিয়া ও গিনিতে বন্দর নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তারা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, আফ্রিকায় এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান। প্রথমত, তাঁর লক্ষ্য আফ্রিকার দেশগুলিকে চিনের ঋণের ফাঁদ থেকে বার করে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমি দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের কথা বলে নীল নদ বা সাহারা-কালাহারিতে তাদের ঢোকার রাস্তা চিরতরে বন্ধ করা। আর সেই কাজে ধীরে ধীরে সাফল্য পেতে শুরু করেছেন তিনি।
এর্ডোগান মুখে যা-ই বলুন না কেন, আফ্রিকার সম্পদের দিকে তাঁর যে লোভ নেই, সে কথা ভাবলে ভুল হবে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে সোনা ও তামার খনিতে কাজ করছে তাঁর দেশের সম্পদ অনুসন্ধানকারী সংস্থা লিডিয়া ম্যাডেনসিলিক এবং মিলার হোল্ডিং। ২০২৩ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নাইজারে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। কুর্সিতে বসেই ফ্রান্স-সহ পশ্চিমি দেশের খনি সংস্থাগুলির বরাত বাতিল করে দেয় নতুন শাসক। সেই ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলাতে এতটুকু দেরি করেনি তুরস্ক।
ইউরেনিয়াম, তেল এবং গ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য নাইজারের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ইতিমধ্যেই চুক্তি সেরে নিয়েছে আঙ্কারা। এ ছাড়া আফ্রিকায় বস্ত্র এবং জ্বালানি ক্ষেত্রে ব্যাপক লগ্নি করছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। বিশেষজ্ঞদের দাবি, নিজের দেশের ক্রমবর্ধমান শিল্পের কাঁচামাল এবং শক্তির প্রয়োজন ‘অন্ধকার মহাদেশ’ থেকে মেটাতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান।
আফ্রিকার লিথিয়াম, কোবাল্ট এবং নিকেলের ভান্ডারের দিকেও লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আঙ্কারা। সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের অস্ত্র ব্যবসাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রেসিডেন্ট এর্ডোগানের। আর তাই একের পর এক দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আফ্রিকার দেশকে অত্যাধুনিক হাতিয়ার বিক্রি করেছে তুরস্ক। তালিকায় রয়েছে, সোমালিয়া, লিবিয়া এবং ইথিওপিয়া। এর মাধ্যমে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আঙ্কারার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার ছবি ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি, ‘আফ্রিকার শিং’ (হর্ন অফ আফ্রিকা) এবং এডেন উপসাগরের একচ্ছত্র আধিপত্য চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান। এর জন্য সুচতুর ভাবে সোমালিয়াকে ব্যবহার করতে চাইছেন তিনি।
অবস্থানগত দিক থেকে সোমালিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। একে ‘আফ্রিকার শিং’ (হর্ন অফ আফ্রিকা) এবং এডেন উপসাগরের দরজা বলা যেতে পারে। ২০১৭ সালে ‘জলদস্যু’দের দেশটির রাজধানী মোগাদিশুতে সবচেয়ে বড় একটি সেনাছাউনি তৈরি করে তুরস্ক। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘টার্কসোম’। সোমালিয়ার সমুদ্রের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পেট্রোলিয়ামের খোঁজও চালাচ্ছে আঙ্কারা।
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নেটো জোটের অংশ হিসাবে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় জলদস্যু দমন অভিযান বাড়িয়েছে তুরস্ক। পাশাপাশি আল-শাবাব এবং বোকো হারামের মতো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফ্রিকার দেশগুলিকে হাতিয়ার এবং অর্থ দিয়ে নানা ভাবে সাহায্য করছে আঙ্কারা। এ ছাড়া লোহিত সাগরের বুকে সুদানের সুয়াকিন দ্বীপকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে ৯৯ বছরের লিজ় চুক্তি করেছেন এর্ডোগান।
অটোমান আমলে সুয়াকিন দ্বীপে ঐতিহ্যবাহী বন্দর নির্মাণ করে তুরস্ক। পরবর্তী কালে অবশ্য সেই জৌলুস আর থাকেনি। দ্বীপটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলে সেটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান। আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে রয়েছে আমেরিকা, ফরাসি এবং চিনের সেনাছাউনি। সেখানে ফৌজি ঘাঁটি তৈরির জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছে আঙ্কারা।
ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধে ‘খেলা ঘুরিয়ে’ দেয় তুরস্কের অতি উন্নত ‘বের্যাকটার’ আত্মঘাতী ড্রোন। এই মানববিহীন উড়ুক্কু যানের দাপটে পিছু হটতে বাধ্য হয় বিদ্রোহী সেনা। ফলে কেনিয়া, উগান্ডা এবং তিউনিশিয়ার মতো দেশগুলিতে বৃদ্ধি পেয়েছে আঙ্কারের অস্ত্রের চাহিদা। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) আফ্রিকায় ১,০২০ কোটি ডলারের হাতিয়ার রফতানি করেছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, আফ্রিকায় ‘নব্য অটোমানবাদ’ নিয়ে আসার চেষ্টা করছে তুরস্ক। মুসলিম সংহতির কথা বলে ফের একবার ইসলামীয় দুনিয়ার ‘খলিফা’ হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে আঙ্কারার। আর তাই ‘আফ্রিকার সমস্যার আফ্রিকান সমাধান’-এর স্লোগান দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোগান। এতে দুনিয়া জুড়ে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করতে চাইছেন তিনি।
অন্য দিকে, তুরস্কের এই ক্ষমতাবৃদ্ধিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছে মিশর, আলজিরিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। আঙ্কারাকে সাম্রাজ্যবাদী ছাড়া আর কিছুই মানতে রাজি নন তারা। ফলে আফ্রিকায় প্রেসিডেন্ট এর্ডোগানের স্বপ্ন সফল হওয়া মোটেই সহজ নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।