দক্ষিণেশ্বর রেল স্টেশন থেকে মেট্রোর সূচনার মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত জনতা, স্টেশন ও চত্বরের সাজে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস নিজস্ব চিত্র
রামকৃষ্ণদেব, সারদাদেবী, স্বামী বিবেকানন্দ। সামনে ধ্যানস্থ রানি রাসমণি। আর সবার উপরে ভবতারিণীর অবয়ব।
সোমবার যখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নোয়াপাড়া-দক্ষিণেশ্বর মেট্রোর সূচনা করছেন, তখন দুধ-সাদা ওই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘দুই কালী তীর্থ যেমন এক সুতোয় বাঁধা পড়ল, তেমনই মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখে এই মূর্তি যেন এলাকার নাম-মাহাত্ম্যকে আরও বেশি মাত্রায় ফুটিয়ে তুলল।’’ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি পূর্ব রেলের টিকিট কাউন্টারের পাশেই তৈরি হয়েছে সুসজ্জিত মেট্রো স্টেশন।
যা দেখে দক্ষিণেশ্বরে আসা দর্শনার্থীরা বলছেন, ‘‘এক দিকে স্কাইওয়াক, অন্য দিকে ঝাঁ-চকচকে, সাজানো মেট্রো স্টেশন। দুইয়ে মিলে একটু অন্য রকম সৌন্দর্যের ছোঁয়া লাগল গোটা এলাকায়।’’ স্কাইওয়াকে দাঁড়িয়ে পিছনে নতুন মেট্রো স্টেশনকে রেখে নিজস্বী তুলছিলেন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। তাঁদেরই এক জন রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বেশ লাগছে কিন্তু দেখতে। শুনেছি, মেট্রো স্টেশনের ভিতরেও দারুণ সাজিয়েছে।’’
অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন, সেই সঙ্গে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিতেই সেজেছে কালী তীর্থ দক্ষিণেশ্বরের মেট্রো স্টেশন। ঢোকার রাস্তা থেকে প্ল্যাটফর্ম, সর্বত্রই রয়েছে তার ছোঁয়া। দক্ষিণেশ্বর রেল স্টেশনে পৌঁছনোর রাস্তা দিয়ে ঢুকে ডান হাতেই হয়েছে মেট্রো স্টেশনটি। পূর্ব রেলের স্টেশনে
ওঠার পথ ও মেট্রোর মাঝের ঢালু অংশে তৈরি হয়েছে বাগিচা। লাগানো হয়েছে বাহারি গাছ। আবার মেট্রো স্টেশনে ঢোকার রাস্তার বাঁ দিকের বাগানে বসানো হয়েছে বিভিন্ন মূর্তি। রয়েছে কলসি-বোঝাই গরুর গাড়ি, দাঁতাল হাতি, কচ্ছপ, হরিণ-সহ টেরাকোটার নানা ভাস্কর্য, অন্যান্য মূর্তি এবং ফোয়ারা। ‘‘মেট্রোয় চড়ার ব্যাপারে বাচ্চাদের এমনিই উৎসাহ থাকে। স্টেশনে ঢুকে এ সব দেখলে ওরা আরও আনন্দ পাবে,’’ বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সনাতন রায়।
দক্ষিণেশ্বর স্টেশন ও চত্বরের সাজে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস ও লোকশিল্পের নানা টুকরো নিজস্ব চিত্র
স্টেশনের বাইরের দেওয়ালও সেজেছে বিভিন্ন শিল্পকলায়। স্টেশনে ঢুকে চলমান সিঁড়িতে ওঠার আগেই দর্শন মিলবে রামকৃষ্ণদেব, সারদাদেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের। দোতলায় উঠেই এক দিকের দেওয়ালে দেখা যাবে শহরের বিভিন্ন স্থাপত্য, যানবাহন ও পরিবহণ ব্যবস্থার অতীত এবং বর্তমানের নানা আঙ্গিকের ছবি। রয়েছে দক্ষিণেশ্বর মন্দির, নিবেদিতা সেতু, বালি সেতু, বেলুড় মঠ, হাওড়া সেতু, জিপিও, হাইকোর্ট, প্রিন্সেপ ঘাট, রাজভবন, কালীঘাট, মহাকরণ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, নিউ মার্কেট, হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রাম, হলুদ-কালো ট্যাক্সি, দোতলা বাস, অ্যাপ-ক্যাব। এর পাশাপাশি, এখন যেখানে দক্ষিণেশ্বর ও বরাহনগর মেট্রো স্টেশন গড়ে উঠেছে, সেখানকার কয়েক বছর আগের পরিস্থিতি এবং মেট্রো প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ ও এখনকার ঝলমলে ছবিও রয়েছে। মেট্রোর প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে ফুটে উঠেছে বাংলার দুর্গাপুজোর আবাহন-বিসর্জন, সিঁদুর খেলা ও থিম পুজোর চেনা ছবিও।
এ ছাড়াও গোটা স্টেশন চত্বরের বিভিন্ন থাম ও দেওয়াল সাজানো হয়েছে বাংলার লোকশিল্পের কারুকাজে। সেই সবেরই ছবি এ দিন মোবাইলে বন্দি করতে দেখা গেল রেলরক্ষী বাহিনীর জওয়ান থেকে মেট্রোর কর্মীদের। স্টেশনের দেওয়ালেই গ্লোসাইন বোর্ডে জানানো হয়েছে, উত্তর-দক্ষিণ এই করিডরে কী কী দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রাখা হয়েছে গ্রাহক সেবা কেন্দ্রও। স্মার্ট কার্ড-সহ যে কোনও সমস্যায় পড়লে যাত্রীদের এ দিক-ও দিক ছুটতে হবে না। ওই কেন্দ্রে গেলেই মিলবে সহায়তা। আবার মেট্রো থেকে নেমে সহজে পূর্ব রেলের স্টেশনে যাওয়ার জন্যও রয়েছে দরজা। রয়েছে শৌচালয়ের ব্যবস্থাও।
এ দিন প্রথম মেট্রো কত ক্ষণে দক্ষিণেশ্বর স্টেশন ছেড়ে যাবে, তা দেখার অপেক্ষায় পূর্ব রেলের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে ভিড় জমিয়েছিলেন সাধারণ যাত্রী থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা। কেউ দাঁড়িয়েছিলেন স্কাইওয়াকে। বিকেল ৪টে বেজে ৫৫ মিনিটে দক্ষিণেশ্বর থেকে নোয়াপাড়ার দিকে রওনা দিল প্রথম মেট্রো। হাত নেড়ে স্বাগত জানালেন অপেক্ষায় থাকা মানুষজন। তাঁদেরই মধ্যে শুভদীপ চৌধুরী, সৌরভ দাসেরা বললেন, ‘‘বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।’’