প্রতীকী ছবি।
দক্ষিণ কলকাতার রাস্তায় বিয়েবাড়ির বাস আটকে অবাক কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীরা। বাসভর্তি যাত্রী নিয়ে যিনি স্টিয়ারিংয়ে বসে, তিনি ভাল করে তাকাতেই পারছেন না! নাম বলতেও তোতলাচ্ছেন। ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার যন্ত্র নিয়ে এসে পরীক্ষা করতেই জানা যায়, চালক মত্ত অবস্থায় রয়েছেন। সেই সময়ে তাঁর শরীরে প্রতি ১০০ মিলিমিটার রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা ছিল ৬৮ মিলিগ্রাম! সাধারণত ওই মাত্রা ৩০ মিলিগ্রামের বেশি হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গাড়ি চালানোর অনুপযুক্ত বলে ধরা হয়।
নিয়ম মেনে এর পরে ওই চালককে গ্রেফতারির তোড়জোর শুরু করতেই শুরু হয় গোলমাল। বাসে থাকা যাত্রীরা রাস্তায় নেমে ঝামেলা শুরু করেন। দাবি, ওই বাসচালককে গ্রেফতার করা যাবে না। অন্য কেউ বাসটি চালিয়ে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দিলেও তাঁরা যাবেন না। বাস চালাতে দিতে হবে ওই মত্ত চালককেই! পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বুঝে খবর যায় লালবাজার কন্ট্রোল রুমে। এর মধ্যেই থানায় ফোন চলে আসে দুই প্রভাবশালীর। তাঁদেরও ‘আর্জি’, ছেড়ে দেওয়া হোক ওই চালককে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গ্রেফতার করে রাখা যায়নি ওই চালককে। জরিমানার পরে স্টিয়ারিংয়ে বসবেন না, এই শর্তে বাসের সঙ্গেই ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে।
এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে কড়া হাতে ধরপাকড়ের চেষ্টা হলেও বেশির ভাগ সময়েই এমন পরিণতি হচ্ছে বলে অভিযোগ। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীদেরই দাবি, ধরার পরে অনেককে থানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার আগেই আসছে প্রভাবশালীর ফোন। কখনও থানায় নিয়ে যাওয়া গেলেও তা আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে না, বরং জামিনযোগ্য ধারায় জরিমানা করেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। উত্তর কলকাতার একটি ট্র্যাফিক গার্ডের পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘থানায় নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, জামিন পেয়ে যাচ্ছেন মত্ত চালক। ফিরে এসেই কেন ধরেছি, এই বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’
মধ্য কলকাতার আরও একটি ট্র্যাফিক গার্ডের সার্জেন্ট বললেন, ‘‘দু’দিন আগেই এক চিকিৎসককে ধরেছিলাম। এক হাতে মদের বোতল, অপর হাতে স্টিয়ারিং ধরে রাতের শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু গ্রেফতার করা যায়নি। প্রভাবশালীর ফোন আসার পরে আমাকেই জবাবদিহি করতে হয়েছে যে, কেন লোক না বুঝে আটকানো হয়েছে!’’
মত্ত গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কৌশল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। অনেকেরই দাবি, মুম্বইয়ে যেখানে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়লে জরিমানা, লাইসেন্স খারিজের পাশাপাশি হাজতবাসেরও পথ রয়েছে, সেখানে এ শহরে শুধু জরিমানা দিয়েই বহু ক্ষেত্রে মিলছে ‘মুক্তি’। কিছু ক্ষেত্রে তিন মাসের জন্য লাইসেন্স খারিজ করা হচ্ছে বলে লালবাজারের দাবি। কিন্তু ট্র্যাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের (এসি) মুখোমুখি হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি সাজাতে পারলে সেই ‘শাস্তিও’ সহজেই এড়ানো যায় বলে জানাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা।
এমনিতে মত্ত অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ে বসে ধরা পড়লে কলকাতা পুলিশ মোটর ভেহিক্লস আইনের ১৮৫ ধারায় ব্যবস্থা নিতে পারে। নিয়মমতো পুলিশ চালকের ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার পরীক্ষা করিয়ে সেই রিপোর্টে চালককে দিয়ে সই করিয়ে তাঁকে থানার হাতে তুলে দেবে। বাজেয়াপ্ত করা হবে গাড়িটিও। এর পরে কোনও সরকারি হাসপাতাল থেকে শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে মত্ত থাকার নিশ্চিত প্রমাণ নিয়ে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে থানা। এ ক্ষেত্রে এক বার আইন ভাঙায় ২০০০ টাকা এবং একাধিক বার একই অপরাধে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
কিন্তু পুলিশকর্মীরা জানাচ্ছেন, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করা হয় বলে আইনজীবীর মাধ্যমে জরিমানা মিটিয়ে সেই রাতেই জামিন পেয়ে যেতে পারেন মত্ত চালক। পরের দিন আদালতে হাজির হয়ে রিলিজ় অর্ডার নিয়ে এলে গাড়িও আটকে থাকে না।
অপেক্ষাকৃত এই ‘নরম’ সাজার কারণেই কি হুঁশ হচ্ছে না চালকদের? লালবাজারের ট্র্যাফিক বিভাগের এক শীর্ষ কর্তা যদিও বললেন, ‘‘আগের চেয়ে এ নিয়ে অনেক বেশি কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কোনও প্রভাবশালীর ফোনেই কাউকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন নেই। ট্র্যাফিক পুলিশের কর্তারাও ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে যাতে তাঁদের ফোন না করা হয়, সেই বার্তা দিয়েছেন প্রকাশ্যে।’’
কিন্তু এর পরেও পরিস্থিতি বদলাচ্ছে কি?