সন্তানশোক: বেহালার বাড়িতে সৌরনীলের বাবা-মা।
চৌকির এক দিকে পাশ ফিরে শুয়ে ছটফট করছেন তিনি। বালিশে মাথা নেই। উস্কোখুস্কো চুল। চোখে-মুখে যন্ত্রণা স্পষ্ট। বাঁ উরুর কাছে ব্যান্ডেজ করা। সেখানেই প্লেট বসেছে। ব্যান্ডেজ রয়েছে বাঁ পায়ের পাতাতেও। সেই অংশেই ফের পচন ধরেছে। মাঝেমধ্যেই ব্যান্ডেজের আশপাশ দু’হাতে দিয়ে চেপে ধরার চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসছে অস্বস্তির শব্দ!
ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন বাবা সরোজকুমার সরকার। বেহালা চৌরাস্তার কাছে লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত সাত বছরের শিশু সৌরনীল সরকারের বাবা তিনি। ক্লান্ত স্বরে বলেন, ‘‘বাবুর হাত ধরে সে দিন রাস্তাটা প্রায় পেরিয়েই গিয়েছিলাম। হঠাৎ লরিটা চলতে শুরু করল। ধাক্কায় পড়ে গেলাম। মনে হল, পায়ের উপর দিয়ে ভারী কিছু চলে গেল। এর পরে দেখি, কাছেই ছেলেটা উবু হয়ে পড়ে। নিজের দিকে যত টানছি, দেখি নড়ে না..!’’ গলা বুজে আসে তাঁর। অস্ত্রোপচারের ব্যথাকেও ছাপিয়ে যায় ছেলে হারানোর যন্ত্রণা।
পুজোর বাকি আর সপ্তাহ তিনেক। মণ্ডপ বাঁধা চলছে জোরকদমে। আলোর রোশনাইয়ে শহর রাত জাগবে। কিন্তু কোথাও কোথাও ঝাড়বাতির নীচেও রাতপাখির মতো জেগে থাকবে আঁধার। ৪ অগস্টের সকাল বদলে দিয়েছিল যে সরকার দম্পতির জীবন, তাঁদের ঘরের সব আলো নিভে গিয়েছে সে দিনই। সেই সকালেই বড়িশা হাইস্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বেরিয়েছিলেন সরোজ।
রাস্তা পারাপারের সময়ে লরি পিষে দেয় ছোট্ট ছেলেটাকে। সরোজের পায়ের উপর দিয়ে লরির চাকা চলে যায়। এসএসকেএম হাসপাতালে দু’দফায় অস্ত্রোপচার হয়। ১২ দিন পরে তাঁকে ছুটি দেয় হাসপাতাল। বাড়ি ফেরার পরে পায়ে পচন ধরতে শুরু করলে ২২ অগস্ট ফের এসএসকেএমে ভর্তি করাতে হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর ছুটি হয় তাঁর। এখন সপ্তাহে দু’বার হাসপাতালে যান সরোজ।
শোকের পাহাড় বয়ে প্রতিদিনের লড়াই করছেন দম্পতি। দোকান চালানোর অবস্থা সরোজের না থাকায় তাঁর ছোট মুদির দোকান এখন বন্ধ। সন্তানকে বড় করতে এক সময়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলের কাজ ছেড়েছিলেন সৌরনীলের মা দীপিকা সরকার। এখন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে চলেছেন। সাড়া মিলছে না। তার মধ্যে সপ্তাহে দু’বার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় সরোজকে। প্রতি বার অ্যাম্বুল্যান্স খরচ তিন হাজার টাকা। অন্য ওষুধের সঙ্গে জুড়েছে ইনসুলিন, সুগার মাপার স্ট্রিপ কেনার খরচ।
সরকার পরিবারের সম্পত্তি বলতে এখন সৌরনীলের বই-খাতা ভর্তি স্কুল-ব্যাগ, শোকেসে সাজানো খেলনা, টেডি বিয়ার, প্লাস্টিকের গাড়ি। দরজায় সাঁটা সৌরনীলের আঁকা শিব ঠাকুরের ছবি। সে দিকে তাকিয়ে দীপিকা বলেন, ‘‘শেষের কিছু দিন শুধু শিব ঠাকুরের ছবি আঁকছিল। আমি ওকে শিবের গল্প বলতাম। শিব যে দুর্গার স্বামী, সেটা জানার পর মণ্ডপে দুর্গাঠাকুর দেখলেই প্রশ্ন করত, শিব কেন দুর্গার সঙ্গে আসে না?’’ নতুন পোশাকের বায়না ছিল না সৌরনীলের। কিন্তু পুজোয় প্রতিদিন ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেই হত।
পয়লা বৈশাখের সময়েই নাতির জন্য পুজোর জামা কিনে রেখেছিলেন দিদিমা। সেই পুজো আসছে নির্ঘণ্ট মেনে, কিন্তু নতুন জামা খানিকটা আগে পরেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে তাঁর নাতি। ‘‘ওই পোশাক পরেই শেষযাত্রায় গেল ছেলেটা।’’ শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না চেপে সৌরনীলের মা বলেন, ‘‘আমাদের পুজো বলে আর কিছু নেই, সংসারটাই শেষ হয়ে গেল! পুজোর রং বরাবরের জন্য ফিকে হয়ে গিয়েছে।’’