প্রতীকী চিত্র।
আচমকা রোগটির প্রকোপ কেন বাড়ল, তা এখনও অজানা। চিকিৎসক মহলেও এ নিয়ে বিবিধ মত রয়েছে। কিন্তু ছত্রাকঘটিত সেই সংক্রমণ, মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসার খরচ যে আকাশছোঁয়া, তা নিয়ে অবশ্য সকলেই একমত।
স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্রের বক্তব্য, গত দু’-আড়াই মাসে শুধু মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসার পিছনেই রাজ্যের খরচ হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক কোটি টাকা। কারণ হিসেবে দফতরের ব্যাখ্যা, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক-এক জন রোগী-পিছু খরচ হয় আড়াই থেকে সাড়ে আট বা দশ লক্ষ টাকা। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরবর্তী ছ’মাসের চিকিৎসার খরচও প্রায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত এক জন রোগীর হাসপাতালে থাকা থেকে পরবর্তী ছ’মাসের মোট চিকিৎসার খরচ চার থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা বলছেন, ‘‘সেই জন্য রোগী-পিছু এক মাসের গড় খরচ ধরা হচ্ছে আট লক্ষ টাকা। গড়ে ১০-১২ জন রোগীর চিকিৎসায় খরচ হচ্ছে এক কোটি টাকার মতো।’’
এত খরচ কেন? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত কোনও রোগী হাসপাতালে থাকাকালীন তাঁকে ‘লাইপোজ়োমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি’ ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। রোগীর প্রতি কেজি ওজন অনুযায়ী পাঁচ মিলিগ্রামের ডোজ় দেওয়া হয়। অর্থাৎ, এক জন রোগীর যদি ৬০ কেজি ওজন হয়, তা হলে তাঁকে দৈনিক ‘লাইপোজ়োমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি’ ইঞ্জেকশনের ৩০০ মিলিগ্রাম ডোজ় দিতে হবে। ওই ইঞ্জেকশনটি ২১ থেকে ৪২ দিন পর্যন্ত দিতে হয়। একটি ভায়ালে ৫০ মিলিগ্রাম ওষুধ থাকে। অর্থাৎ, প্রতিদিন ৩০০ মিলিগ্রাম করে ইঞ্জেকশন দিতে ছ’টি ভায়ালের প্রয়োজন। এক-একটি ভায়ালের দাম প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘দিনে ছ’টি ভায়াল ব্যবহারে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় একটি মাত্র ইঞ্জেকশনের জন্য। ন্যূনতম ২১ দিন চললেও শুধু ওই ইঞ্জেকশনের পিছনেই খরচ ছ’লক্ষ টাকার বেশি।’’
তবে এই ওষুধটির বাজারে তেমন জোগান না থাকায় কিছু ক্ষেত্রে (মৃদু উপসর্গযুক্ত সাধারণ রোগীর কিডনির কোনও সমস্যা না থাকলে) ‘অ্যাম্ফোটেরিসিন ডিঅক্সিকোলেট’ ইঞ্জেকশনও ব্যবহার করা হয়। সেটির দাম অপেক্ষাকৃত কম। পাশাপাশি, হাসপাতালে থাকাকালীন এক-এক জন রোগীর অন্তত তিন-চার বার এমআরআই-সহ অন্যান্য পরীক্ষা, ওষুধপত্র ও প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার, পরিকাঠামো মিলিয়ে খরচটা বেশ কয়েক লক্ষে দাঁড়াচ্ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, রোগীকে বাড়ি ফিরে ‘অ্যান্টি-ফাঙ্গাল’ ট্যাবলেট ‘পোসাকোনাজ়োল’ খেতে হয়। প্রথম দিন ৬০০ মিলিগ্রাম, তার পর থেকে দৈনিক ৩০০ মিলিগ্রাম। প্রতিটি ট্যাবলেট ১০০ মিলিগ্রামের। খোলা বাজারে একটি ট্যাবলেটের দাম সাড়ে চারশো-পাঁচশো টাকার মতো। যদিও খোলা বাজারে ওই ওষুধ অমিল।
প্রশাসন সূত্রের খবর, টেন্ডারের মাধ্যমে এক-একটি পোসাকোনাজ়োল ট্যাবলেট প্রায় ৩০০ টাকায় কিনেছে স্বাস্থ্য দফতর। সেই অনুযায়ী, এক জন রোগীর প্রথম দিন ১৮০০ টাকা এবং তার পর থেকে প্রতিদিন ৯০০ টাকা করে ২৯ দিনের হিসেবে মাসে প্রায় আটাশ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বললেন, ‘‘হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ে ও পরবর্তী ছ’মাসের জন্য যে দামি ইঞ্জেকশন এবং ওষুধের প্রয়োজন, তা বাজারে অমিল। কিন্তু তা-ও টেন্ডার করে দ্রুততার সঙ্গে সেই সমস্ত প্রয়োজনীয় ওষুধের জোগান রাখা হচ্ছে। ক্যানসারের চেয়ে বেশি খরচের চিকিৎসা হলেও রাজ্য সরকার বিনামূল্যে তা দিতে বদ্ধপরিকর।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই টেন্ডার ডেকে প্রথম পর্যায়ে প্রায় তিন হাজার ‘লাইপোজ়োমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি’ ই়ঞ্জেকশন, ২৫ হাজার ‘পোসাকোনাজ়োল’-সহ অন্যান্য ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মহল সূত্রের খবর, আগে বছরে মেরেকেটে চার-পাঁচ জন মিউকরমাইকোসিস রোগীর খোঁজ মিলত রাজ্যে। এখন সেই সংখ্যক রোগীই দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছেন। গত শনিবার পর্যন্ত রাজ্যে ২৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩০ জন, মারা গিয়েছেন ৫৮ জন। বাকি ১৫৮ জনের চিকিৎসা চলছে। প্রাণে বাঁচলেও বহু রোগীরই মুখ, চোখের একাংশ বাদ গিয়েছে। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ, স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং এসএসকেএমে এই রোগের চিকিৎসা চলছে।