ছবি সংগৃহীত
প্রথমে হয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, নয়তো গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সংক্রান্ত আইনের নির্দিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের হতে হবে। তার পরে বিচারকের নির্দেশ মেনে যে দু’টি মোবাইলে কথোপকথন হয়েছে বলে অভিযোগ, সেই দু’টিকে বাজেয়াপ্ত করা হবে। তার পরে তা যাবে ফরেন্সিক বিভাগে। যে দুই ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথন হয়েছে, তাঁদের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। সেই নমুনার সঙ্গে ‘কল রেকর্ডিং’-এর কণ্ঠ মিলে গেলে এবং অন্য কোনও অসঙ্গতি নেই বলে ফরেন্সিক বিভাগ রিপোর্ট দিলে তার পরে শুরু হবে বিচার।
কিন্তু ভোটের বঙ্গে এই মুহূর্তে এত সময় রয়েছে কার হাতে? দ্রুত ‘বিচার’ করে ফেলতে এখন তাই সবটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘জনতার দরবারে’। কোনও রকম তথ্যপ্রমাণ, আইনকানুনের ব্যাপার নেই। তাৎক্ষণিক আবেগের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে, কোনটি অপরাধ আর কোনটি নয়। যেটিকে অপরাধ বলে ধরে নেওয়া হল, তার সাজাও ঠিক হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। সাজার ফরমানও এসে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেই। একাংশের ‘মনগড়া’ সেই ফরমানের জোরে রাতারাতি বাকিদের মনও বিদ্বেষ-বিষে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ। আইনজীবী থেকে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকদের বড় অংশেরই বক্তব্য, “এ এক এমন প্রক্রিয়া, যাতে ব্যক্তিগত পরিসর বলে আর কিছুই থাকছে না। আইনের পথে না এসে তাৎক্ষণিক বিচার করে দেওয়ার তাড়না পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতাকেই গলা টিপে খুন করছে। সেই খুনেরও কোনও বিচার হচ্ছে না।”
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হয়ে কাজ করে দেওয়ার জন্য বিরোধী দলের এক কর্মীকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন বলে শোরগোল চলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। ব্যক্তিগত পরিসরের কথোপকথনের সেই অডিয়ো রেকর্ডিং আনন্দবাজার পত্রিকা যাচাই করেনি। তবে শুধু ওই অডিয়োই নয়, এই মুহূর্তে দল নির্বিশেষে একাধিক এমন অডিয়ো বা ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে, যার বড় অংশই ব্যক্তিগত পরিসরের। কোথাও বাইরে চলে এসেছে নিজের দলের এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার ভোটের রণনীতি তৈরি করার আলাপচারিতা, কোথাও অভিনেত্রী প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকের একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের কথোপকথন। নিজস্ব রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে বসে মুখ্যমন্ত্রীর চোট পাওয়া পা দোলানোর ভিডিয়ো এই তালিকা আরও দীর্ঘ করেছে।
আইনজীবী শ্যামল সরকার বললেন, “পায়ে চোট আছে কি না, সেটা তো চিকিৎসকেরা বলবেন। কিন্তু ভিডিয়ো দেখে মনে হচ্ছে, ওই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী
ব্যক্তিগত পরিসরে নিজের দলের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই ভিডিয়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া যে বেআইনি, সেটা কে বোঝাবে?”
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “কোনও পক্ষই তো মামলা করছে না। মামলা না হলে বড় অংশের মানুষেরই মনে হতে পারে, যা খুশি অডিয়ো বা ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।” আইনজীবী দেবকুমার চন্দ্র আবার বললেন, “সিসি ক্যামেরা যেখানে থাকে, সেখানেও উল্লেখ করে দিতে হয় যে, আপনি নজরদারি ক্যামেরার অধীনে রয়েছেন। যত মামলা কম হবে, অন্যায়টা ততই যেন ন্যায় বলে মনে হতে শুরু করবে।”
জয়ন্তনারায়ণবাবু জানান, মোবাইল ফোনের অডিয়ো রেকর্ডিং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আদালতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী দলের ওই যুবক জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের বলে তাঁকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছে বলে মামলা করতে পারতেন। মুখ্যমন্ত্রীরও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কেউই মামলার পথে হাঁটেননি। তাঁর কথায়, “আসলে কেউই মামলা চান না। ভোটের ময়দানে হাতেগরম সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালই সকলের পছন্দ।” আইনজীবী অরূপ চৌধুরী বললেন, “ভোটের সময়ে বড় বড় নেতা-নেত্রীদের ঘিরে হওয়া কার্যকলাপ অপরাধ জগতের নানা দিক মনে করায়। কোনও তরুণীর ব্যক্তিগত অডিয়ো বা ভিডিয়ো এ ভাবে ছড়িয়ে দিয়েই তো অপরাধ সংঘটিত হয়। সাধারণ মানুষকে দিনরাত আইনের পাঠ পড়ানো এই নেতারা নিজেরা আইনের পথে না হেঁটে অপরাধ প্রবণতাকেই আরও উস্কে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন না তো?”
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বললেন, “সদিচ্ছার অভাব তো সকলেরই। ব্যক্তি পরিসর নিয়ে এমন খেলা শুধু নীতি-বিরুদ্ধ নয়, বেআইনিও। যে দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিচ্ছু নেই, একমাত্র সেই দেশেই এমন হতে পারে। আমার দেশে, আমার রাজ্যেই এমন হচ্ছে দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করছি।”