পরিশ্রান্ত: মাঝপথে একটু বিশ্রাম। শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কেউ আবেদন করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে চলেছেন। কেউ বছর ঘুরতে চললেও সাড়া না পেয়ে আশা ছেড়েছেন! যাঁরা সদস্য হতে পেরেছেন, তাঁদেরও কারও মৃত্যু ঘটছে শেষ সময়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কারও
প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে থানায় ঘুরে ঘুরেই সময় কাটছে! সুরাহা মিলছে না। কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্প ঘিরে এমনই নানা অভিযোগ সামনে আসছে। যার জেরে আরও একটি ‘বিশ্ব প্রবীণ দিবসে’ প্রশ্ন উঠছে, প্রণাম প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে।
এই প্রেক্ষিতেই উঠে এল কলকাতা পুলিশের অন্দরে ধোঁয়াশার দিক। একাধিক থানার
পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রণাম প্রকল্পের একাধিক বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণাই নেই তাঁদের। হরিদেবপুরের এক বাসিন্দার যেমন অভিযোগ, প্রণাম প্রকল্পে সদস্য হওয়ার জন্য দেড় বছর ধরে আবেদন করে বসে আছেন। কিন্তু সাড়া মেলেনি। কেন? জানা গেল, বৃদ্ধাকে জানানো হয়েছে, তাঁর ছেলে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে থাকেন, তাই তাঁকে সদস্য করা কঠিন। কলকাতা পুলিশের কর্তারা যদিও জানাচ্ছেন, এমন কোনও নিয়ম নেই। ২০০৯ সালে প্রণাম প্রকল্পের শুরুর সময়ে এক বার দূরত্বের প্রসঙ্গ উঠেছিল। কিন্তু বয়স্কদের বিরুদ্ধে অপরাধের
একাধিক ঘটনা সামনে আসায় সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আর জটিলতা বাড়ানো হয়নি।
বেলেঘাটার সত্তরোর্ধ্ব এক দম্পতির আবার অভিযোগ, তাঁদের ছেলে একই বাড়িতে থাকেন। কিন্তু বাবা-মাকে ওই ছেলে বা ছেলের পরিবার দেখেন না।
চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া বা অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা সাহায্য করেন না! অথচ, স্থানীয় পুলিশকর্মীর দাবি, একই বাড়িতে ছেলে বা মেয়ের মধ্যে কেউ এক জন থাকলে প্রণামের সদস্য পদ মেলে না। কিন্তু এক বাড়িতেই সন্তানের সঙ্গে থাকেন অথচ তাঁদের থেকে সাহায্য পান না, এমন বয়স্কদের ক্ষেত্রে কী হবে? এ ব্যাপারেও
পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, এই সমস্ত ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে সদস্য করার কথা বলা আছে।
গিরিশ পার্কের এক অশীতিপর বৃদ্ধা আবার জানাচ্ছেন, তিনি কিছু দিন আগে ভাইয়ের ছেলেকে দানপত্র করে নিজের বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন সেই ছেলে। এখন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ তো ছেড়েই দিন। সদস্য হিসাবে প্রণামের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের ফোন করেও সাহায্য পাই না। যখনই ফোন করি, বলা হয়, থানায় লোক কম আছে।’’ পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রতিটি থানায় অন্তত ১৩ জন করে পুলিশকর্মী থাকেন, যাঁদের কেউ না কেউ প্রয়োজন পড়লেই বয়স্কদের সমস্যা শুনতে যেতে পারেন।
এ ছাড়া এক জন অফিসারের অধীনে তিন জন পুলিশকর্মী নিয়ে প্রণাম দল তৈরি করা আছে প্রতিটি থানায়। তাঁরাই তালিকা ধরে ধরে এলাকার বয়স্কদের খোঁজখবর নেন। তাঁদের অভাব-অভিযোগ শোনার পাশাপাশি কারা বয়স্কদের বাড়িতে কাজ করছেন, সেই তালিকা নিয়ে রাখেন। কল সারাতে বা বাড়িতে বিদ্যুতের কাজ করাতে হলেও যে শ্রমিককে ডাকা হয়, তাঁরও সচিত্র পরিচয়পত্র নিয়ে রাখার কথা এই পুলিশকর্মীদের। এই মুহূর্তে শহরে প্রণামের সদস্য রয়েছেন প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার।
কিন্তু ভুক্তভোগী প্রবীণদের বড় অংশেরই অভিযোগ, প্রায়ই থানার অফিসার বদল হন। সমস্যায় পড়ে ফোন করলে বয়স্কেরা দেখেন, হয় কেউ ফোন ধরছেন না। নয়তো ফোন ধরেই বলছেন, ‘‘আমি বদলি হয়ে গিয়েছি। থানায় করুন।’’ শব্দতাণ্ডব রুখতেই হোক বা জরুরি সময়ে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে দেওয়া, থানার নম্বরে ফোন করলেও বহু ক্ষেত্রেই সাড়া মেলে না!
এর মধ্যেই মাথা চাড়া দিয়েছে বয়স্কদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলার ছক। লিঙ্ক বানিয়ে কলকাতা পুলিশের লোগো বসিয়ে ভুয়ো ‘প্রণাম’ সদস্য বানানো হচ্ছে বলে লালবাজারে জানিয়েছেন রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরা। এমনকি ওই দফতরের ওয়েবসাইটও ব্যবহার করা হচ্ছে এই কাজে। লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসার বলছেন, ‘‘সব দিক দেখা হচ্ছে। কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে আলাদা করে গুরুত্ব দিতে বলেছেন পুলিশ কমিশনার। কোনও ধোঁয়াশার জায়গা নেই। এই সব বিষয়ে গাফিলতি দেখলেই কড়া পদেক্ষেপ করা হবে।’’ (চলবে)