অবিচল: জুনিয়র চিকিৎসকদের অবস্থান-বিক্ষোভ। সোমবার মধ্যরাতে, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
রাত ৩টে বেজে ৪৪ মিনিট। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পুলিশি ব্যারিকেডের দু’পাশেই অনেকের চোখে তখন ঝিমুনি। আচমকাই অবস্থান থেকে মাইকে বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন সকলেই। গান শেষ হতেই আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের হাততালিতে ভেসে গেল শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা। স্লোগান উঠল, ‘এই তো পুলিশ দাঁড়িয়েছে’।
সোমবার লালবাজার অভিযানে ফিয়ার্স লেনে পুলিশি ব্যারিকেডে আটকে গিয়েছিল জুনিয়র চিকিৎসকদের মিছিল। প্রতিবাদে বিকেল থেকে রাস্তাতেই বসে অবস্থান-বিক্ষোভের কর্মসূচি নেন তাঁরা। তবে, প্রথম থেকেই তাঁদের দাবি ছিল, কোনও সংঘাত নয়। তাই গোটা রাত জুড়েই আন্দোলনকারীদের বড় অংশ সমস্বরে কবিতা পাঠ, গান, প্যারডি করেই আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জিইয়ে রাখলেন। তাল মেলাতে বাজালেন খালি জলের বোতল। আর, মাঝেমধ্যে ব্যারিকেডের ও-পারে থাকা পুলিশকর্মীদের বললেন, ‘‘আমাদের ৩৬-৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করার অভ্যাস আছে। তাই, এত সহজে আমাদের পরাস্ত করা যাবে না।’’ তবে, উভয় পক্ষের সৌহার্দ্যের ছবিও দেখা গিয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া পুলিশকর্মীদের হাতে জল-কেক তুলে দিয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। আবার মঙ্গলবার সকালে পুলিশও তাঁদের ঠান্ডা পানীয়, জল দিয়েছে।
সোমবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া অবস্থান-বিক্ষোভে সাধারণ মানুষকেও পাশে চেয়ে বার্তা দিয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। সময় গড়িয়ে যত রাত বেড়েছে, ততই সাধারণ মানুষ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীতশিল্পীরা এসে যোগ দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে। কোনও সময়ে তাঁরা সকলে মিলেই গিটার, বাঁশি বাজিয়ে গেয়ে উঠেছেন ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির বিভিন্ন গান। এক দলের গলায় যখন গান-কবিতা, তখন অন্য দল রাস্তাতেই প্লাস্টিক পেতে একটু বসে বা শুয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। কখনও আবার শুয়ে থাকা জুনিয়র চিকিৎসকদের তাঁর সহপাঠীরা ঘুম থেকে তুলে গান ধরেছেন, ‘কারার ওই লৌহ কপাট...’।
রাত বাড়লেও প্রতিবাদের জোর কমেনি। বরং পুলিশের লোহার ব্যারিকেডে ‘অভয়ার বিচার চাই’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে, তার সামনে বসেই প্রায় গোটা রাত কাটিয়ে দেন কয়েক জন জুনিয়র চিকিৎসক। স্লোগান তুললেন— ‘তোমার আমার এক স্বর, জাস্টিস ফর আর জি কর’। দাবি উঠল, নগরপালের পদত্যাগেরও। কিন্তু সারা রাতের আন্দোলন তো খালি পেটে হবে না। তাই, রাত ১২টা নাগাদ তাঁদের জন্য কলকাতা মেডিক্যাল, আর জি কর এবং এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ থেকে খিচুড়ি, রুটি, তরকারি রান্না করে আনা হয়েছিল। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সিনিয়র চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষেরাও।
রাতে নিউ আলিপুরের শৌভিক ঘোষ, মণিকা ঘোষ তাঁদের একমাত্র সন্তান সক্ষমকে নিয়ে এসেছিলেন আন্দোলনকারীদের মাঝে। এক সময়ে জম্মুর হাসপাতালের নার্স মণিকা বলেন, ‘‘আমার ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। তাই আজ ওকে নিয়ে এসে দেখালাম, আসল ডাক্তার কারা। ছেলেকে বলেছি, সন্দীপ ঘোষের মতো ডাক্তার হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।’’ মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাইকে বেজে ওঠে ‘বন্দে মাতরম’ গান। অবস্থানের দ্বিতীয় দিনের প্রস্তুতির ঘোষণার পরে ফের বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত। আবারও দুই প্রান্তেরই সকলে উঠে দাঁড়ালেন। এক আন্দোলনকারীর কথায়, ‘‘যত দিন অবস্থান চলবে, রোজ এমন ভাবেই পুলিশকে চাঙ্গা করা হবে।’’
যদিও, এ দিন দুপরের পরে তার আর প্রয়োজন হয়নি। বরং তাঁদের দাবি মতোই ব্যারিকেড সরিয়ে দেওয়ায়, আন্দোলনকারীরা লক্ষ্যে পৌঁছনোর যাত্রা শুরু করলেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানে গলা মিলিয়ে।