মেটিয়াবুরুজের সেই পানের দোকান। —নিজস্ব চিত্র।
ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ‘আওয়াধের রাজা’র একটি দুর্লভ আঁকা ছবি একদা শোভা পেত মেটিয়াবুরুজের পানের দোকানটিতে। তিন দশক আগে গোলমালের ঘটনায় তা লুট হয়ে গিয়েছে।
রবিবার ওয়াজিদ আলি শাহের ২০০ বছরের জন্মদিনে অশীতিপর রামদুলারি সাইনির কণ্ঠে ছবিটির জন্য আফশোস ঝরে পড়ছিল। মেটেবুরুজের কাচ্চি সড়ক মোড়ে প্রসিদ্ধ ‘শাহি পানের’ দোকানের স্বর্গত কর্তা রমেশ মালি সাইনির মা রামদুলারি। তিনি তাঁর পুত্র থেকে শুরু করে শ্বশুরকুলের পাঁচ পুরুষের হিসেব দেবেন। রামদুলারির স্বামী মোতিবাবুর ঠাকুরদা বুদ্ধুলাল মালির বাবা বিহারিলাল মালিই নির্বাসিত নবাবের সঙ্গে লখনউ থেকে কলকাতায় এসে পানের দোকান খোলেন। রামদুলারি বললেন, “বিহারিলাল মালির সাজা ‘ছাঁচ পান’ (ছাঁচিপান) খেয়ে নবাব খুশি হয়ে না কি এক টাকা দিতেন! তখনকার দিনে এক রুপিয়ার দাম বুঝতে পারছেন?”
কিংবদন্তীর কুহক ঘেরা মেটিয়াবুরুজে এ সব সত্য যাচাই করার অবকাশ নেই! তবে নবাবের প্রতি তাঁর সাবেক প্রজার পরিজনের আনুগত্যে আজও খাদ মেশেনি। ওয়াজিদ আলি শাহের মেটিয়াবুরুজ তথা সমকালীন কলকাতা নিয়ে সাম্প্রতিক একটি বইয়ের লেখক, ডাক্তারবাবু সুদীপ্ত মিত্রের কাছে শোনা কাহিনি, নবাবের পান যে-সে পান নয়! খেয়ে সব সময়ে তাঁর শরীর গরম থাকত বলেই তৎকালীন কলকাতার কড়া শীতেও তিনি ফিনফিনে বস্ত্র পরেই থাকতেন। শোভাবাজারের রাজা রূপেন্দ্রকৃষ্ণ দেব এক বার মেটিয়াবুরুজ থেকে গান শুনে ফেরার সময়ে সেই পান খেয়ে তার তেজ টের পেয়েছিলেন। শোভাবাজারের পরিবারের নানা জনের লেখায় ঘটনাটির উল্লেখ আছে। সুদীপ্ত আক্ষেপ করেন, “ওয়াজিদ আলি শাহের মতো সুলেখক, সঙ্গীতবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে বাঙালি মোটেই মনে রাখেনি! বাংলার নবজাগরণের সময়ে অভিজাত বাঙালির জীবনচর্যাতেও তিনি নানা মাত্রা জোড়েন।” মেটিয়াবুরুজের হোলি, কত্থক বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা বঙ্গজীবনেরও অলঙ্কার হয়ে ওঠে।
এ কালের মেটিয়াবুরুজে শুধুই ওয়াজিদ আলি শাহের বিরিয়ানি এবং চিড়িয়াখানার গল্প ভাসে! ব্রিটিশের পেনশনের টাকাতেও বিচিত্র পশুপাখির সম্পদ নবাব লালন করতে ছাড়েননি। আর শোনা যায়, তাঁর মহরমের শোভাযাত্রায় মুসলিম, হিন্দু সবার শামিল হওয়ার গল্প। মহরমের অনুষ্ঠানের পরের দুপুরে স্থানীয় ব্যবসায়ী হামিদ রশিদ বলেন, মহরমে রাতভর হল্লা হলেও জুলুস (শোভাযাত্রা) অনেক ছোট এখন।” সিবতায়নাবাদ ইমামবাড়ায় নবাবের সমাধি ঘিরে জন্মদিনে শুধু মার্জিত ভাবে ফতেহাখানি বা শ্রদ্ধা নিবেদনটুকু হল বিকেলে।
নবাবের সঙ্গে আসা পরিবারগুলির উত্তরপুরুষদের এখন সহজে দেখা মেলে না। ২০২২-এ রমেশবাবুর প্রয়াণের পরে পানের দোকানটি কিছু জটিলতায় বন্ধ ছিল। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধির হস্তক্ষেপে ফের খুলেছে। কর্মচারীরাই দোকানে বসেন। তবে নবাবের নাম-মহিমায় ভাটা নেই। পাশের চৌরাসিয়ার পানের দোকানও নবাবের বিরাট ছবি টাঙিয়েছে। সম্প্রীতি মঞ্চ ‘নো ইয়োর নেবার’ এবং ইনট্যাকের উদ্যোগে ২০০ বছরে ওয়াজিদ আলির ঐতিহ্য মেলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
নবাবের উত্তরপুরুষ কামরান মির্জা বলছিলেন, “ছোটবেলায় গ্রহদোষ কাটাতে নবাব-জননী রানি মা তাঁকে জন্মদিনে ছাই মাখিয়ে গেরুয়াবেশে সাজাতেন। আওয়াধি ঘরানায় হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশেলের ধারাই ওয়াজিদ আলির ঘরানা।” নবাবের জন্মদিনের মেটিয়াবুরুজও ভারতের সমন্বয়ের আদর্শের কথা বলছে।