বেলঘরিয়ার একটি রেশন দোকান। নিজস্ব চিত্র
দাবি ছিল, ‘করোনা ত্রাণে’ দান করতে হবে কয়েক বস্তা চাল আর গম। কিন্তু তাতে রাজি হননি রেশন দোকানের অশীতিপর মালিক। লকডাউনে কিছু না বললেও ‘আনলক’ পর্বে দাবি না মানার ফল টের পেয়েছেন ওই বৃদ্ধ। নিজে অল্পের জন্য ইটের আঘাত থেকে বাঁচলেও তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু এখনও আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে বৃদ্ধ দোকানিকে। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘আবার যদি হামলা করে!’’
করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ দেওয়ার নামে রাজ্য জুড়ে রেশনের চাল-গম লুটের অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করতে হয়েছিল খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই ঘোষণার পরে তখনকার মতো জুলুম কমলেও পরবর্তী সময়ে দাবি না-মানা দোকানিদের যে কী ধরনের ‘দাদার দাপট’ সহ্য করতে হচ্ছে, তার প্রমাণ কামারহাটির ওই ঘটনা।
লকডাউনের প্রথম পর্বে রেশন নিয়ে স্থানীয় দাদাদের জুলুম মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলেই অভিযোগ এলাকার সিপিএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘খাদ্য দফতর ও পুলিশ-প্রশাসনকে বার বার সমস্যার কথা জানিয়েছি। তাদের যা করণীয় ছিল, তারা তা করেনি।’’ অভিযোগ, করোনা পরিস্থিতিতে দরিদ্রদের ত্রাণ দেওয়ার নামে রেশন দোকানিদের উপরে কার্যত জুলুম চালিয়েছেন স্থানীয় কিছু দাদা। তবে দোকানিদের প্রত্যেকেই যে দাদাদের নির্দেশ মেনে বস্তা বস্তা চাল-গম পাঠিয়ে দিয়েছেন, তা-ও কিন্তু নয়।
আরও পড়ুন: সংক্রমিত কর্মী, নব মহাকরণে জীবাণুনাশ জোরকদমে
সেই কারণেই কামারহাটির ওই বৃদ্ধের মতো আতঙ্কে রয়েছেন বেশ কয়েক জন দোকানি। যাঁদের অভিযোগ, লকডাউন শুরু হতেই ত্রাণের সামগ্রী জোগাড়ের নামে জুলুম শুরু হয় রেশন ডিলারদের উপরে। কার থেকে কত বস্তা চাল আর কত বস্তা গম ওঠানো হবে, তার তালিকাও আগাম তৈরি থাকত। সেই মতো দাদাদের সঙ্গীরা প্রতিদিন নিয়ম করে পৌঁছে যেতেন বিভিন্ন দোকানে। জিনিসপত্র দোকানে ঢুকতেই তা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, তার ঠিকানা দিয়ে দিতেন ওই কেষ্ট-বিষ্টুরাই। আর কথা না শুনলে কিংবা চাল-গমের বস্তা পাঠাতে গড়িমসি করলেই আসত দাদাদের ফোন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানির কথায়, ‘‘ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ঠান্ডা গলার অনুরোধ যে আসলে হুমকি, তা বুঝতে অসুবিধা হত না।’’ অভিযোগ, ত্রাণের নামে আদায় করা জিনিসে এক-এক জন দাদা তো নিজেরই গুদাম বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেখানেই পৌঁছে যেত চাল, গম। প্রথম দিকে বিনামূল্যে ওই সব আদায় করা হলেও পরের দিকে চাল-গমের বিনিময়ে দোকানিদের কিছু টাকা দিতেন দাদারা। দাদাদের চাপে পড়ে সেই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন দোকানিদের একাংশ। আর তাই গ্রাহককে রাজ্য সরকারের পাঁচ কেজি করে চাল এবং কেন্দ্রের পাঁচ কেজি করে চাল বা গম দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হত না। দেওয়া হত, যে কোনও একটি প্রকল্পের পাঁচ কেজি চাল বা গম।
কিন্তু রেশন দোকানের চাল-গমের জন্য জুলুম চালাতেন কারা?
অভিযোগকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, চাল-গমের জন্য জুলুম করা দাদারা প্রায় সকলেই শাসক দলের কোনও না কোনও পদে রয়েছেন। কেউ আবার এলাকার কোনও ‘প্রাক্তন প্রভাবশালী’ দাদার ঘনিষ্ঠ। প্রায় সব ক’টি অভিযোগই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যদিও কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের দাবি, ‘‘এই সমস্ত অভিযোগ পুরো ভিত্তিহীন। কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে এবং তা যাঁর বিরুদ্ধেই হোক, আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন।’’
আবার কামারহাটি পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের বেলঘরিয়া টাউনের সভাপতি গোপাল সাহার কথায়, ‘‘অভিযোগ যে একেবারে কানে আসছে না, তা নয়। তবে যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা সরাসরি আমাদের কাছে লিখিত ভাবে জানালে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।’’
কিন্তু ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, ‘‘বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে!’’