অনিয়ম: রথযাত্রায় ডিজে বাজিয়ে নাচ। শুক্রবার, শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
গত দু’বছর বন্ধ থাকার পরে এ বছর, শুক্রবার রথের চাকা গড়াল শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে। কোথাও ভিড়ের চাপে রাস্তা বন্ধ করে পুলিশকে অন্য দিকে গাড়ি ঘোরাতে দেখা গেল। কোথাও আবার রথ থেকে উড়ে আসা প্রসাদ লুফে নিতে জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এ সবের সঙ্গেই মাস্কহীন মুখে রথ টানার ধুম দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না যে, নতুন করে ঊর্ধ্বমুখী করোনার লেখচিত্র। বিকেলের পরে আরও বেপরোয়া হতে দেখা গেল মানুষকে। পাড়ার গলিতে মাস্কহীন কচিকাঁচাদের রথ নিয়ে বেরোনোর সঙ্গে টক্কর দিলেন বড়রাও। ধর্মতলা, গড়িয়াহাটে কেনাকাটার ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো।
দক্ষিণ কলকাতায় ইস্কনের রথযাত্রা ঘিরে প্রবল উৎসাহ থাকেই। এ বারেও তেমনই ছিল। দুপুর থেকে সেখানে উৎসবমুখী জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। শরৎ বসু রোড, হাজরা, এস পি মুখার্জি রোড এক সময়ে প্রায় থমকে যায়। সেখানে কাতারে কাতারে লোককে দেখা যায় রথের দড়ি ধরে টানার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে। সিংহভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। রথের দায়িত্বে থাকা ইস্কনের সদস্যেরা কয়েক জন প্রথমে মাস্ক পরলেও পরে তাঁদেরও অনেককে দেখা গেল তা খুলে ফেলতে। সেই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে নাজেহাল এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা গেল, ‘‘হু-হু করে করোনা ছড়াচ্ছে। বাহিনীতেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এমন ডিউটি করে আমাদের কী হবে, জানি না।’’ এর পরেই তাঁর গলায় আশঙ্কা, ‘‘রথে আনন্দ করার খেসারত হিসেবে করোনা বেড়ে গেলে দুর্গাপুজোটা এ বারও না ঘেঁটে যায়।’’
এই সব ভাবনাচিন্তার প্রকাশ এ দিন অবশ্য সে ভাবে আর কোথাও কানে আসেনি। ইস্কনের পাশাপাশি এ দিন সকাল থেকেই নানা জায়গার রথ পরিক্রমায় বেরিয়েছিল। এ দিন রীতি মেনে দুর্গার কাঠামো পুজোও করলেন অনেকে। বিকেলের দিকে শহরের একাধিক রাস্তায় রথের শোভাযাত্রার জন্য যান নিয়ন্ত্রণ করতে হয় পুলিশকে। উত্তর কলকাতায় এমনই একটি রথযাত্রায় উপস্থিত এক মহিলা বললেন, ‘‘দু’বছর আনন্দ করতে পারিনি। এ বার যখন সব হচ্ছে, রথ বেরোবে না কেন! বাড়ি ফিরে ছেলেকে নিয়ে বেরোব। সে-ও রথ কিনে রেখেছে।’’
বিকেলে দেখা গেল, রথ হাতে এলাকায় এলাকায় বেরিয়ে পড়েছে খুদেরা। তাদের মুখে মাস্ক নেই, উদাসীন অভিভাবকেরাও। এমনই এক বালকের বাবার মন্তব্য, ‘‘ও সব নিয়ে আর ভাবছি না। বরং বেশি দুঃখ পেয়েছি পাঁপড়ের দাম শুনে। ভোজ্য তেলের দাম যা বেড়েছে, তাতে পাঁপড়ে হাত দিলেই ছেঁকা লাগছে।’’ সন্তানের রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার পথে অন্য এক অভিভাবক বললেন, ‘‘এখন স্কুল খুলে গিয়েছে। সেখানে কে মাস্ক পরছে আর কে পরছে না, সেটা কে দেখছে?’’
শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ যদিও বললেন, ‘‘কলকাতায় আক্রান্তের সংখ্যা এবং পজ়িটিভিটি রেট, দুটোই এই রাজ্যের সব জেলার মধ্যে বেশি। এর পরেও আমরা সতর্ক হব না? বাচ্চারা তো বায়না করবেই।’’
গড়িয়াহাটের ভিড়ে মাস্কহীন এক মহিলার বক্তব্য, ‘‘মাস্ক না পরা এখন কোনও ব্যাপার নয়। আমি অবশ্য মাস্ক সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছিলাম। পথে একটা রথ দেখে দড়ি টানতে গিয়ে ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে।’’ দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের একটি শপিং মলে ঢোকার মুখে তড়িঘড়ি মাস্ক পরতে ব্যস্ত এক তরুণকে আবার দেখা গেল সঙ্গীদের বলছেন, ‘‘গেট পার করে খুলে ফেললেই হবে। কড়াকড়ি নেই। এই সব উৎসবের দিনে যে কোনও জায়গায় ঢোকার জন্য মাস্ক রাখতেই হয়।’’
হৃদ্রোগ চিকিৎসক কুণাল সরকারের মন্তব্য, ‘‘হয়তো আমরা চতুর্থ ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এমন বেপরোয়া মনোভাব ছেড়ে এখনই সতর্ক না হলে কিন্তু নতুন করে বিপদ আসন্ন।’’