এসএসকেএম হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে খুদে পায়েল মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
প্রথম সন্তান হওয়ার খুশিতেই ছিল মহেশতলার মণ্ডল পরিবার। কিন্তু সদ্যোজাতের মুখ দিয়ে বার বার গ্যাঁজলার মতো কিছু উঠতে থাকায় তরুণী মা ভেবেছিলেন, মেয়ের ঠান্ডা লেগেছে। কিন্তু বিষয়টি ভাল ঠেকেনি শিশুরোগ চিকিৎসকদের। তখনই ওই সদ্যোজাতকে এসএসকেএমের নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে পাঠান তাঁরা। সেখানে ওই সদ্যোজাতকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা দেখেন, তার খাদ্যনালি অসম্পূর্ণ। এমনকি নেই পায়ুদ্বারও।
একমাত্র সন্তানের এমন হতে পারে, প্রথমে তা বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি মা পূজা মণ্ডল। বার বার ভেবেছেন, ‘ডাক্তারবাবুরা ঠিক বলছেন তো?’ সদ্যোজাত মেয়ের এমন শারীরিক সমস্যার কথা শুনে দিশাহারা অবস্থা হয়েছিল বাবা বাপি মণ্ডলেরও। কী করণীয়, বুঝে উঠতে পারছিলেন না বেসরকারি সংস্থার কর্মী বাপি। সেই সময়েই এক দিনের ওই শিশুর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটাল শল্য চিকিৎসকেরা। প্রথমে এক দিন বয়সের শিশুটির খাদ্যনালি, তার ঠিক ২২ দিন পরে পায়ুদ্বার অস্ত্রোপচার করে নতুন জীবন ফিরিয়ে দেয় রাজ্যের এই সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল।
মহেশতলার চকমারির মণ্ডল দম্পতির মেয়ে পায়েলের বয়স এখন ন’মাস। মঙ্গলবার মেয়েকে নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে চেক-আপ করাতে এসেছিলেন পূজা। খিলখিল করে হাসা মেয়েকে কোলে নিয়ে মা বললেন, ‘‘মেয়ে যে আমার ভাল ভাবে সুস্থ হয়ে উঠবে, ভাবিনি। এত দুষ্টুমি করে, কে বলবে কয়েক মাসে ওর অস্ত্রোপচার হয়েছে।’’
হাসিখুশি-ছটফটে পায়েলকে দেখে বেজায় খুশি তাকে অস্ত্রোপচার করা নিওনেটাল শল্য চিকিৎসক শুভঙ্কর চক্রবর্তীও। তাঁর কথায়,‘‘ওকে হাসতে দেখে আমাদেরও স্বস্তি। শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এসএসকেএম হাসপাতালেই জন্ম হয় পায়েলের। জন্মের পরেই চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন শিশুটির কী সমস্যা। এর পরে তাকে নিওনেটাল বিভাগে স্থানান্তরিত করতেই সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায়,ওই শিশুর খাদ্যনালি গলার নীচে শেষ হয়ে গিয়েছে। আর পেটের দিক থেকে ওঠা খাদ্যনালি গিয়ে মিশেছে শ্বাসনালীর মধ্যে। অর্থাৎ উপরের সঙ্গে নীচের খাদ্যনালির কোনও যোগ নেই। চিকিৎসার পরিভাষায় যেটিকে বলা হয়, ‘ইসোফেগ্যাল অ্যাট্রেসিয়া উইথ ট্র্যাকিয়ো ইসোফেগ্যাল ফিসচুলা’। আবার পরীক্ষায় দেখা যায়, ওই শিশুর পায়ুনালী যোনিপথের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। যার ফলে প্রস্রাবের দ্বার দিয়েই মলত্যাগ করছে সদ্যোজাত। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘অ্যানোরেক্টাল ম্যালফর্মেশন’।
শুভঙ্করবাবু বলেন, ‘‘দু’টি সমস্যা একত্রিত হয়ে শিশুটি ‘ভ্যাকট্রেল কমপ্লেক্স’-এর মধ্যে ছিল। এটি খুবই বিরল ঘটনা। বিশ্বে ৩০ হাজার সদ্যোজাতের মধ্যে এক জনের এমন সমস্যা হয়।’’ তাই ন’মাস আগে যখন পায়েলের অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত হয়, তখনই নিওনেটাল শল্য চিকিৎসকেরা ঠিক করেন, প্রথমে খাদ্যনালির অস্ত্রোপচার করার কয়েক দিন পরেই পায়ুদ্বারটিও অস্ত্রোপচার করা হবে। এর পরেই ছয় সদস্যের চিকিৎসক-দল তৈরি হয়। তাতে ছিলেন নিওনেটাল শল্য চিকিৎসক শুভঙ্করবাবু, দীপঙ্কর রায়, সুমন দাস, অ্যানাস্থেটিস্ট প্রবীর দাস, গৌতম পিল্লাই, অমৃতা রায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে প্রথম দিনের অস্ত্রোপচার। চিকিৎসকেরা জানান, সদ্যোজাতের বুক কেটে প্রথমে গলার নীচে শেষ হওয়া খাদ্যনালির শেষ প্রান্ত খুঁজে বের করা হয়। তার পরে শ্বাসনালি থেকে খাদ্যনালিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর পরে দু`টি খাদ্যনালির মুখ একসঙ্গে জোড়া হয়।
এই অস্ত্রোপচারের পরে শিশুটিকে দু’দিন ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। পূজা বলেন, ‘‘মেয়ে তার পর থেকে নিজে মুখেই খেতে শুরু করে। আর গ্যাঁজলার মতো কিছু বেরোয়নি।’’
টানা ২১ দিন এসএসকেএম হাসপাতালেই ছিলেন মা ও মেয়ে। তার পরে পায়ুনািলকে মাংসপেশীর ঠিক জায়গায় বসিয়ে পায়ুদ্বার তৈরি করা হয়। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যাতে মলত্যাগে স্বাভাবিক বেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা না হয়, সেই ব্যবস্থাও করা হয়। এর কয়েক দিন পরেই ছুটি দেওয়া হয় পায়েলকে।
অস্ত্রোপচারের সময়ে পায়েলের ওজন ছিল প্রায় আড়াই কিলোগ্রাম। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় সাত কিলোগ্রাম। ফলে পায়েল যে স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করতে পারছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত চিকিৎসকেরা। আর খিলখিল করে হেসে ডাক্তারের স্টেথো ধরার চেষ্টা করতেই পূজা বলে ওঠেন, ‘‘রাই, একদম দুষ্টুমি করবে না।’’