Book Fair

বই চোর কি আসলে বইপ্রেমী, পরীক্ষা নিল পুলিশ

হাঁটু মুড়ে বসে মধ্যবয়সি এক ব্যক্তি। তাঁকে ঘিরে পুলিশ আধিকারিকেরা।

Advertisement

কাজল গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:১৩
Share:

হাঁটু মুড়ে বসে মধ্যবয়সি এক ব্যক্তি। তাঁকে ঘিরে পুলিশ আধিকারিকেরা। চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। কেন তিনি চুরি করলেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই প্রশ্নই করা হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু চুরির কথা মানতে নারাজ সেই ব্যক্তি। দোকানের কর্মীরা তাঁকে একটি ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেখেছিলেন। সেই ব্যাগে পাওয়া গিয়েছে কিছু ‘চুরির সামগ্রী’, যার কোনও ক্যাশ মেমো নেই। কিন্তু অভিযুক্তের দাবি, ব্যাগটি আদৌ তাঁর নয়। সিসি ক্যামেরায় অবশ্য দেখা গেল, ওই ব্যাগ নিয়েই অভিযুক্ত দোকানে ঢুকেছিলেন। ধরা পড়তেই কান্নাকাটি শুরু করেন। তাঁর দাবি, কেনার সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়েই চুরি করেছেন।

Advertisement

ঘটনাস্থল, কলকাতা বইমেলা। বই চোর সন্দেহে ধরা হয়েছিল ওই ব্যক্তিকে। চুরি করলেন কেন? পুলিশকে ওই ব্যক্তি জানালেন, তাঁর আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাই বই কেনার ক্ষমতা নেই। কিন্তু বই পড়তে খুব ইচ্ছে করে। উত্তর শুনে খানিক নরম হলেন পুলিশের লোকজন। কিন্তু বই চুরির আসল উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁদের সন্দেহ গেল না। সেই সন্দেহের নিরসন ঘটাতেই এর পরে ‘পরীক্ষকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন এক পুলিশ আধিকারিক। বিভিন্ন বাংলা বইয়ের উল্লেখ করে সেগুলির লেখকদের নাম জানতে চাইলেন তিনি। হালফিলের কয়েক জনের নাম ছাড়া বেশির ভাগ লেখকের নামই ঠিকঠাক বলে দিলেন অভিযুক্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক উপন্যাস থেকে প্রাক্তন এক আমলার বেশ কিছু বইয়ের নাম গড়গড় করে বলে গেলেন তিনি। পুলিশ আধিকারিকেরা তখন নিশ্চিত, অভিযুক্তের বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে।

বইমেলায় এই ঘটনার কথা চাউর হতে অবশ্য সময় বেশি লাগল না। আর সেই সূত্রেই সামনে এল এ বিষয়ে বইপ্রেমীদের নানা মত। কারও কারও বক্তব্য, অনেকেই তো বই কিনে শুধু সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু পড়েন না। এই ব্যক্তি চুরি করলেও পড়বেন বলে করেছেন। কেউ আবার বললেন, ‘‘কত বড় বড় চুরি হচ্ছে। তাদের টিকি ছোঁয়ার সাহস নেই। এক জন বই নিয়েছেন বলে এত কথা হচ্ছে কেন?’’

Advertisement

বস্তুত পুলিশ, সিসি ক্যামেরা ও স্টলে স্টলে কড়া নজরদারি চলায় এ যুগে বইমেলা থেকে বই চুরির ঘটনা অনেক কমে গিয়েছে। দমদমের বাসিন্দা এক বইপ্রেমী বিমান দাশশর্মার কথায়, ‘‘এখন তো অনলাইনেই পড়া যায়। বই চুরির দরকারই তো পড়ে না। লেখকের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তো তাঁর গল্প-উপন্যাস ইন্টারনেটে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে দেওয়া হচ্ছে। বই চুরির থেকে এটা কিন্তু অনেক বড় অপরাধ।’’ বিমানের মতো অনেকেই বলছেন, বই চুরি চলছেই। শুধু যুগের সঙ্গে তার কৌশল বদলে যাচ্ছে।

বই চুরির নানা ঘটনা আজও বইপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। যেমন, আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র বললেন, ‘‘এক বার ময়দানের বইমেলায় আমাদের স্টলে এক মহিলা ঢুকে কয়েকটি বই শাড়ির আঁচলে মুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে সময়ে সেখানে আমাদের মহিলা কোনও সহকর্মী ছিলেন না। ফলে আমরা একটু মুশকিলে পড়ে যাই। মহিলাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়েই শাড়ি থেকে বইগুলি নীচে পড়ে যায়। আমাদের আলাদা করে আর কিছু করতে হয়নি।’’

তিনি জানান, অনেক সময়ে কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে কে কত বই চুরি করতে পারেন, তার প্রতিযোগিতা চলত। ধরা পড়ে সে কথা তাঁরা স্বীকারও করেছেন। আবার এমনও হয়েছে যে, দরিদ্র কোনও যুবক বই নিয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। সেই দৃশ্য দেখে কেউ হয়তো বইয়ের দাম চুকিয়ে তাঁর হাতে সেই বই তুলে দিয়েছেন। বই চুরির ক্ষেত্রে অবশ্য নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। তবে বই-বিক্রেতাদের মতে, কোনও মহিলাকে সন্দেহ হলেও সব সময়ে আটকানো যায় না। সে ক্ষেত্রে দোকানে কোনও মহিলা কর্মী থাকলে সুবিধা হয়।

বই চুরি করে ধরা পড়লে নানা রকম অভিনব শাস্তির কথাও শোনা যায়। যেমন, এক বার কোনও এক স্টলে অভিযুক্তকে বলা হয়েছিল, একটি রচনা বা প্রবন্ধ লিখে দিতে। লেখা ভাল হওয়ায় চুরি করা বই তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। এখন অবশ্য বইমেলায় ধরা পড়লে বইয়ের নির্ধারিত মূল্য দিতে হয় অভিযুক্তকে। সেই দামে কোনও ছাড় পান না তিনি।

এখন স্টলের ভিতরে নজরদারি আর সিসি ক্যামেরার দাপটে বই চুরির ঘটনা খুবই কম।

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বই চুরি বরাবরই ছিল। কিন্তু বই চুরি খারাপ চোখে দেখা হয় না। ধরা পড়লে শাস্তি দেওয়া হয় না। জনসমক্ষে সম্মানহানিও করা হয় না। বইমেলায় বই চুরি করাকে খুব বড় কোনও অপরাধ বলেও মনে করেন না কেউ। ধরা পড়লে বইয়ের দাম নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় কিংবা ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement