—ফাইল চিত্র
কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রভাবে মার্চ থেকেই কার্যত স্তব্ধ গোটা দেশ। ওষুধের অভাব, অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতাল চত্বরে কান্না আর মৃতদেহের সারি— এমন সব দৃশ্য যে দেখতে হবে, দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেননি ভারতবাসী। দান্তের নরকের মতো সে দুঃস্বপ্নই এখন সত্যি।
নদীতে ভেসে যাওয়া শব এ রাজ্যে ছিল না ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রথম দিকে বেশ কিছুটা বেহালই হয়ে পড়েছিল বাংলা। সুখের বিষয়, সেই ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে রাজ্য। তবু আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে এর স্থায়িত্ব নিয়ে।
কারণ, সিঁদুরে মেঘ ঘনাচ্ছে প্রতিষেধক ঘিরে। যদিও এ নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই সমাজকর্মীরা বলেছিলেন, মনোরোগীদের জন্য কতটা জরুরি প্রতিষেধক কর্মসূচি। তাঁদের সব থেকে বড় কোমর্বিডিটি হল মানসিক রোগ। যে কারণে তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এ রাজ্যের একটি প্রথম সারির সংগঠন ওই রোগীদের সার্বিক প্রতিষেধক প্রদান নিয়ে বিভিন্ন স্তরে দাবি পেশ করেছে। জনস্বার্থ মামলা (পিআইএল) দাখিল হয়েছে একাধিক। যার ফলে মানসিক হাসপাতালগুলিতে প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের চারটি মানসিক হাসপাতালের সব আবাসিককে তা দেওয়াও হয়ে গিয়েছে।
তবু প্রদীপের নীচের অন্ধকার যেন কাটছে না। কারণ, মনোরোগীদের বাইরেও বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ ছড়িয়ে রয়েছেন, যাঁরা আমাদের ভাবনার জগতে দখল নিতে পারেননি। অথচ তাঁরাই হয়ে উঠতে পারেন ‘সুপার-স্প্রেডার’। যেমন, গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে, ফুটপাতে অথবা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় সংসার পেতেছেন যাঁরা, সরকারি প্রতিষেধক প্রদান কর্মসূচিতে তাঁদের স্থান কোথায়?
কারণ, প্রতিষেধক নিতে হলে কোউইন নামের মোবাইল অ্যাপে নাম রেজিস্ট্রি করার কথা। লাগবে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো সাতটি সচিত্র পরিচয়পত্রের যে কোনও একটি। যাঁদের এই সাতটি পরিচয়পত্রের কোনওটিই নেই, তাঁদের দায়িত্ব নেবেন সরকারি অফিসারেরা বা হাসপাতাল। কিন্তু এ সব কিছুর যে শুরুর ধাপ, সেই কোউইন অ্যাপে নিবন্ধীকরণের বিষয়টি কার্যকর হবে কী ভাবে? কোনও যথাযোগ্য পথ দেখাতে পারছে না সরকারি নির্দেশিকা।
ফলে ডিজিটাল ভারতের আলোকবৃত্তের বাইরে থাকা অন্য ভারতকে যেন আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে কোউইন অ্যাপ।
প্রশ্ন রইল অনেক। সার্বিক প্রতিষেধক প্রদানের জন্য অ্যাপে নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ কেন বাধ্যতামূলক? যাঁদের স্মার্টফোন নেই, তা চালানোর উপায় জানা নেই, এমনকি অক্ষরজ্ঞানও নেই, তাঁরা কি তবে প্রতিষেধক পাবেন না? পুরসভা এবং পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এই কাজটা কি আরও ভাল ভাবে করা যেত না? এর আগে যখন পালস পোলিয়ো কর্মসূচি হয়েছে, তখন তো অ্যাপের প্রয়োজন পড়েনি। তবে কোউইন অ্যাপের ঢক্কানিনাদ দরকার কেন?
কোভিড প্রতিষেধক নিয়ে যত বিজ্ঞপ্তি এসেছে, তা ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে সে সব হয়েছে সক্ষম, বিত্তবান জনগোষ্ঠীর কথা ভেবেই। উপেক্ষিত হয়েছেন ভবঘুরে, নিরাশ্রয়, রোহিঙ্গা, রিফিউজি শিবিরের
মানুষেরা। মনে রাখতে হবে, কোভিড প্রতিষেধকের সঙ্গে নাগরিকত্বের যোগ নেই। বরং অনেক বেশি সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যের অধিকার। এই প্রতিষেধক পানীয় জলের মতোই অপরিহার্য। সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যের অধিকার মানেই জীবনের অধিকার, অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার। তা হলে কোউইন অ্যাপে নাম নথিবদ্ধ করা, ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের মতো হাজারটা তথ্যদান জরুরি হবে কেন? তার চেয়ে দরজায় দরজায় গিয়ে প্রতিষেধক দিলে কর্মসূচি আরও দ্রুত এবং সফল হত বলেই মনে হয়।
ভাবছি, অতিরিক্ত ডিজিটাল হতে গিয়ে সংবিধান-স্বীকৃত স্বাস্থ্য আর অস্তিত্ব রক্ষার অধিকারকে অস্বীকার করে অ-ডিজিটাল নাগরিককে অদৃশ্য হয়ে যেতে বলছে না তো রাষ্ট্র?
(লেখক একজন সমাজকর্মী)