রঙিন: বড়বাজারে দোলের আগে বিক্রি হচ্ছে রং। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
নামেই ভেষজ। কিন্তু, রঙের জেল্লার দাপটে হার মানাতে পারে রাসায়নিক আবিরকেও! দোলের আগে শহরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেল, এমন আবিরেরই রমরমা। কিন্তু, সেগুলি আদৌ ভেষজ কি না, সেই শংসাপত্র দেওয়ার কেউ নেই। এক-একটিতে ‘ভেষজ’ লেখা স্টিকার সাঁটা। বেশির ভাগ প্যাকেটে তা-ও নেই। এই ধরনের আবিরের কোথায় পরীক্ষা হয়েছে, কারা পরীক্ষা করেছেন, তার কোনও তথ্য নেই। নেই ক্রেতাদের সচেতনতাও। পুলিশি নজরদারিও চোখে পড়ে না। উদাসীন প্রশাসনও। অভিযোগ, নিষিদ্ধ বাজি ঘিরে যতটা প্রতিবাদ বা মামলা করার উদ্যোগ দেখা যায় পরিবেশকর্মীদের মধ্যে, এ ক্ষেত্রে তা-ও নেই। বেশ কিছু বিক্রেতা আবার ভেষজ আবির বলে যে কিছু হয়, তা যেন শোনেনইনি কখনও!
২০০৫ সালেই অবশ্য ভেষজ আবির তৈরির পদ্ধতি দেখিয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ফি-বছর এই ধরনের আবির ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে বিক্রিও করা হয়। রাজ্যের বহু জেলায় যাদবপুরের শেখানো পথে সে সব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ, সরকারি সাহায্য বিশেষ না থাকায় বহু ক্ষেত্রেই ওই আবির বেশি মাত্রায় বাজারে পৌঁছচ্ছে না। যাদবপুরের প্রাক্তন সহ-উপাচার্য তথা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সিদ্ধার্থ দত্ত বলেন, ‘‘হাওড়ার মল্লিকঘাটে প্রতিদিন যত ফুল আসে, তার ৪০ শতাংশ অবিক্রীত থেকে যায়। সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পরে গঙ্গায় ফেলায় দূষণ ছড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ওই ফুল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ভেষজ আবির তৈরি করেছি। গাঁদা, অপরাজিতা, পলাশের পাপড়ির সঙ্গে ট্যালকম পাউডার জাতীয় পদার্থ মেশাতাম আমরা। তাতে অ্যারারুটের মতো স্টার্চ জাতীয় পদার্থ মেশানো হত। পাপড়ির সঙ্গে সবটা যাতে ভাল ভাবে মাখে, তার জন্য ফিটকিরিও দিতাম। বাজার থেকে আনা গন্ধও মেশানো হত। গায়ে মাখলে সুন্দর গন্ধ বেরোবে। হালকা রং। মুছলেই উঠে যাবে। কিন্তু, ক্ষতিকর কিছু থাকবে না।’’ সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘এখন ভেষজ আবিরের নামে বহু জায়গাতেই বিষাক্ত, ক্ষতিকর জিনিস বিক্রি হচ্ছে। মুশকিল হল, ভেজাল আবির ধরার কোনও কল আছে বলে আমার জানা নেই।’’
পরিবেশবিদ ও গবেষকদের দাবি, এই সুযোগেই বিকোচ্ছে সব ধরনের আবির। বড়বাজারে ভেষজ আবিরের নামে চকচকে এক জিনিস বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। এমনই একটি দোকানের মালিক সোনু সিংহ বললেন, ‘‘এটাই ভেষজ আবির। যত চকচকে হবে, ততই পরিবেশবান্ধব!’’ যদিও গবেষকেরা বলছেন উল্টোটা। তাঁদের দাবি, ভেষজ আর ভেজাল আবিরের মূল পার্থক্য, ভেষজ আবির মাত্রেই তা চকচকে হবে না।
বড়বাজারেই আর একটি দোকানের সামনে রং ও আবির কেনার ভিড়। দোকানি নীলম সাহানি বললেন, ‘‘ভাল আবির ২০০ টাকা কেজি। দাম বেশি বলে ক্রেতা মেলে না। এখানে অভ্র আর কাচের গুঁড়ো মেশানো ৫ টাকা কেজির আবির আছে।’’ গড়িয়াহাটের এক দোকানির কথায়, ‘‘সাধারণ আবিরে রঙের জন্য অরামিন (হলুদ), ম্যালাকাইট (সবুজ), রোডামিন (কমলা)-এর মতো রাসায়নিক মেশানো হয়। ভেষজ আবিরও চকচকে করতে অনেকে এ সব মেশান।’’ কিন্তু, এমন ক্ষতিকর আবির বিক্রি করাই তো অপরাধ? মেজাজ হারিয়ে মানিকতলার এক বিক্রেতার মন্তব্য, ‘‘পুলিশও এখান থেকে তিন-চার কেজি কিনে নিয়ে গিয়েছে। ধরার হলে তো আগেই ধরত।’’
পুলিশের কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করেননি। যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্তা শুধু বলেন, ‘‘এ নিয়ে তেমন কোনও অর্ডার নেই।’’ পরিবেশকর্মী নব দত্তের বক্তব্য, ‘‘সব ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ জিনিস উৎপাদন করতে দেওয়া হচ্ছে। বাজারে বিক্রির সময়েও বাধা দেওয়া হচ্ছে না। পরে আদালতের নির্দেশ এলে কয়েকটি ধরপাকড় হচ্ছে। বাজির ক্ষেত্রে যেটুকু যা হয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের কড়া নির্দেশে। এ ক্ষেত্রে আমরা, পরিবেশকর্মীরাও সে ভাবে কিছু করিনি। পুলিশ-প্রশাসনেরও উদ্যোগ নেই। ফলে, ক্রেতাকেই বুঝে নিতে হবে নিজের ভাল।’’