বেপরোয়া: মৌলালিতে ভিড় বাসেও মুখ ঢাকা নেই অনেকের। কারও কারও মাস্ক আবার নেমেছে থুতনিতে। মাস্ক ছাড়া মেট্রোয় সফর এক যাত্রীর। নিজস্ব চিত্র।
পর পর তিনটি বাস ছেড়ে দিতে হয়েছে স্রেফ পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাস্কহীন ভিড় দেখেই। চতুর্থ বাসটিতে কোনও মতে উঠতে পারলেও অবস্থা আরও নাজেহাল! যাত্রীদের বেশির ভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। আসন পেয়ে বসার পরে বিপদ মনে হল বেশি। কারণ, সামনে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি পান চিবোতে চিবোতে ফোনে কথা বলা শুরু করতেই আরম্ভ হয়েছিল তাঁর রঞ্জিত থুতুর অকাল বর্ষণ।
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার মাস্ক কোথায়? বেপরোয়া সেই ব্যক্তির উত্তর, ‘‘মাস্ক পরে পান চিবোনোর মজা কোথায়? এমনিই এখন করোনা নেই, পানপাতায় আরও করোনা আসবে না!’’
একটি-দু’টি নয়, গত দশ-পনেরো দিন ধরে শহরের গণ-পরিবহণে এমন যাত্রীদেরই ভিড় বাড়ছে বলে অভিযোগ। প্রায় সর্বত্রই উধাও হতে বসেছে মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস। যা দেখে বোঝার উপায়ই থাকছে না যে, এ শহরের অনেকেই এখনও লড়ছেন করোনার সঙ্গে। মুম্বইয়ের মতো দেশের বেশ কিছু শহরে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা বাড়লেও অনেকের সে দিকে হুঁশ নেই! মাস্ক পরেছেন বলে সহ-যাত্রীকে আবার তাচ্ছিল্যও করতে ছাড়ছেন না। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘‘মাস্কে এখন বোকা বোকা লাগে!’’
বৃহস্পতিবার সকালেই যেমন নোয়াপাড়া থেকে মেট্রোয় উঠেছিলেন এক ব্যক্তি। দমদম পেরোতেই মাস্কহীন যাত্রীর ভিড় দেখে আতঙ্কিত তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “মাস্ক কোথায়?” যাঁরা পরেননি তাঁরা চিৎকার শুরু করে প্রায় মারতে ওঠেন। মাস্ক পরে রয়েছেন এমন অনেকেও বলে উঠলেন, ‘‘করোনা অনেক হয়েছে। নেহাত বার বার খুলতে-পরতে সমস্যা হয়, তাই আমাদের মতো অনেকেই এখনও একটানা পরে থাকেন।’’ গড়িয়াহাট মোড়ে আবার বেশ কয়েকটি অটো ছেড়ে দিয়ে বিরক্ত তমালিকা বসু বললেন, ‘‘অফিসে যাব। এই নিয়ে চারটে অটো ছাড়লাম। সকলেই মাস্ক পরে আছেন, এমন একটা অটোও দেখলাম না! মাস্ক না থাকলে উঠব না বলায় এক অটোচালক বললেন, ‘ও সব দিন গিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকুন তা হলে’!’’ দমদমে শান্তিপুর লোকাল থেকে নামা মাস্কহীন ভিড়ের এক জন আবার বললেন, ‘‘ভ্যাকসিনের জোরেই সকলে ছুটছেন। মাস্ক লাগবে না!’’ আপনি ভ্যাকসিন পেয়েছেন? মাঝবয়সির উত্তর, ‘‘ভ্যাকসিনের কথা কানে তো শুনেছি! তাহলেই হবে।’’
পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতার দিকে ফিরতে গিয়ে কোনও গণ-পরিবহণেই মাস্ক পরা যাত্রী দেখি না। ভ্যাকসিন এসে গিয়েছে ভেবে যাঁরা বীরত্বের সঙ্গে ছুটছেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, ভ্যাকসিন নিয়ে কোনও চিকিৎসককে মাস্ক ছাড়া রোগী দেখতে দেখছেন?
ভ্যাকসিন নিয়েও যদি তাঁদের মাস্ক পরে থাকতে হয়, তা হলে ভ্যাকসিন না পেয়ে কিসের জোরে আপনারা মাস্ক ছাড়া ছুটছেন?’’
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের বক্তব্য, ‘‘আমজনতার কাছে ভ্যাকসিন আসতে মনে হচ্ছে আরও বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। এই পরিস্থিতিতে মুম্বইয়ের পরিস্থিতি দেখেও কি আমাদের শিক্ষা হবে না? তা হলে কি আবার সেই লকডাউনই চাইছি আমরা?’’ কার্ডিয়ো থোরাসিক সার্জন কুণাল সরকারের প্রশ্ন, ‘‘করোনার জেরে জীবন-জীবিকার কী অবস্থা হয়েছিল, সেটা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি? মাস্ক পরে থাকলে যদি সংক্রমণ কমে, আবার লকডাউন এড়ানো যায়, তা হলেও কি সেটা পরব না? তাৎক্ষণিক হিরোইজ়ম কি আমাদের জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখার চেয়েও বড়?’’
নিউরো-মেডিসিনের চিকিৎসক বিমানকান্তি রায় আবার বললেন, ‘‘কড়া বাঁধন না থাকলে আমরা যে বিধি মানি না, তা গণ-পরিবহণের বর্তমান অবস্থা দেখলেই মালুম হয়। যাঁদের এই বিষয়টি দেখা দরকার তাঁরা সকলে কিন্তু ভোট নিয়ে ব্যস্ত। ফের সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ভোট হবে তো?’’