প্রস্তুতি: দশ মাসেরও পরে খুলছে স্কুল। তার জন্য তোড়জোড় দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর। বুধবার, দমদম ক্যান্টনমেন্টে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
এক দিকে প্রায় এক বছর পরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। অন্য দিকে, কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কা এখনও পুরোপুরি না কমায় স্কুলে যাওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়। এই দোলাচলে ভুগছে শহরের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা। কাল, শুক্রবার থেকে স্কুল শুরু হবে তাদের। সংশয় কাটিয়ে স্কুলে যাওয়ার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যেতে অনেকেই নিজেদের মতো প্রস্তুতি শুরু করেছে। তবে অভিভাবকেরা অনেকেই এখনও ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁদের প্রশ্ন, করোনার প্রকোপ পুরোপুরি না কমা পর্যন্ত স্কুলে পাঠানো কি আদৌ নিরাপদ?
তবে স্কুল খোলার ঘোষণায় খুশি কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা, সল্টলেকের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী দীপশিখা কর রায়। তার কথায়, ‘‘স্কুলজীবনের শেষ বছরটা করোনার জন্য স্কুলে যেতেই পারলাম না। খুবই খারাপ লাগছিল। এ বার স্কুলে গেলে পড়াশোনা হবে, আবার বন্ধুদের সঙ্গে সামনাসামনি গল্পও হবে। তা ছাড়া, আমাদের তো প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে হবে। বাড়িতে মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার রয়েছে। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার জন্য নতুন কিছু মাস্ক কিনেছি। স্যানিটাইজ়ারও কিনেছি। স্কুল খুললে ইউনিফর্ম রোজ ইস্ত্রি করতে হবে, জীবাণুমুক্ত করার জন্য।’’ করোনা তো পুরোপুরি যায়নি। স্কুলে যেতে ভয় করবে না? দীপশিখার উত্তর, ‘‘এখন তো নানা কাজে করোনা-বিধি মেনেই বাইরে বেরোচ্ছি। সে ভাবেই স্কুলে যাব।’’
স্কুলে যাওয়া নিয়ে দীপশিখার সংশয় না থাকলেও কিছু অভিভাবক ও পড়ুয়া কিন্তু বক্তব্য, স্কুলে যেতে কিছুটা হলেও ভয় করছে। যেমন, চেতলার বাসিন্দা এক অভিভাবক সুমনা বসু জানালেন, তাঁর মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সুমনার কথায়, ‘‘ওর তো সামনে কোনও পরীক্ষা নেই। দ্বাদশ শ্রেণির মতো প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসও নেই। তাই স্কুল খুললেও ওকে এখনই পাঠাব না বলে ঠিক করেছি। পরিস্থিতি আরও কিছুটা স্বাভাবিক হোক, করোনার প্রতিষেধক আরও বেশি করে মানুষকে দেওয়া হোক, তার পরে ছেলেকে স্কুলে পাঠাব। আমার অনেক বন্ধুও তাদের ছেলেমেয়েদের এখনই স্কুলে পাঠাবে না বলে ঠিক করেছে।’’ সুমনার সঙ্গে সহমত আর এক অভিভাবক সুজাতা রায়। তিনি বললেন, ‘‘স্কুলে গিয়ে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা মাস্ক পরে কী ভাবে থাকবে? ওইটুকু ছেলের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব মেনে সব কিছু করা কি সম্ভব? লকডাউনের পরে আমার ছেলে মাঝেমধ্যে বাইরে বেরোলেও টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বাইরে থাকেনি। টিউশনও নিয়েছে অনলাইনে। তাই ওকে এখনই স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছি না।’’
তবে দ্বাদশ শ্রেণির প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস করার জন্য স্কুলে যেতেই হবে বলে জানাল দমদম ক্যান্টনমেন্টের দু’নম্বর রেলগেট এলাকার বাসিন্দা তৃষা ঘোষ। তৃষা দমদমেরই একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। তার কথায়, ‘‘স্কুলে গেলে সঙ্গে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার তো থাকবেই। সামনেই আমাদের দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষা। কোনও রকমের সংক্রমণ যাতে না হয়, তার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা তো নিতেই হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা ছাড়াও মাস্ক পরে থাকা, টিফিন ভাগ করে না খাওয়া— এগুলো খেয়াল রাখব।’’
স্কুলে যাওয়া নিয়ে প্রথমে কিছুটা সংশয় থাকলেও তা আস্তে আস্তে কেটে যাবে বলেই মনে করছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তিনি বলেন, ‘‘গত এগারো মাস ধরে ওদের দৈনন্দিন রুটিন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে স্কুলে যাওয়ার সমস্ত অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে। এত দিন ওরা বাড়িতে বসে অনেক নিয়ম ভেঙেছে। সেই নিয়ম ভাঙার জীবন থেকে নিয়ম মানার জীবনে ফিরে আসতে একটু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ওরা স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।’’ নীলাঞ্জনাদেবীর কথায়, ‘‘অভিভাবকদের দেখে বাচ্চারা শেখে। তাই অভিভাবকেরাও যেন করোনা-বিধি মেনে মাস্ক পরেন। সব সময়ে স্যানিটাইজ়ার নিয়ে বাইরে বেরোন। না হলে কিন্তু বাচ্চারাও স্কুলে গিয়ে নিয়ম ভাঙবে।’’ মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের বক্তব্য, ‘‘পড়ুয়াদের পুরনো রুটিনে ফিরিয়ে আনার জন্য মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন। তবে প্রথম দিনই যে প্রত্যেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন, এমনটা নয়। অনেকের মনেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। তবে পরিস্থিতি যত স্বাভাবিক হবে, ধীরে ধীরে এই সংশয় কেটে যাবে।’’