সরব: আর জি কর-কাণ্ডের এক মাস পূর্তিতে বিচারের দাবি রং-তুলিতে। রবিবার রাতে, গড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে যাদবপুর পর্যন্ত পথে এ ভাবেই প্রতিবাদ জানালেন মানুষ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
রাজপথই যেন ক্যানভাস। সেখানে আঁকা ছবি, লেখার মেয়াদ হয়তো এক রাতের। বৃষ্টির ধারা, গাড়ির চাকা, মানুষের পায়ে সেই সমস্ত ছবি-লেখা সব ফিকে হয়ে যাবে কয়েক ঘণ্টা পরেই। তবুও এক মাস আগের ৮ অগস্টের রাতের ঘটনার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে, রবিবারেও জেগে থাকল শহর। ঘুম সরিয়ে সারা রাত জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের সামনের আন্দোলন মঞ্চ থেকে গান-কবিতা পাঠ, স্লোগানে সরব হলেন আর জি করের আবাসিক চিকিৎসকেরাও।
তাঁরা বললেন, ‘‘ওই দিন দিদির ( নিহত চিকিৎসক ছাত্রী) আর্তনাদ হয়তো কেউ শুনতে পায়নি। কিন্তু তিনি তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হতে চেয়েছিলেন। তাই, ঘটনার এক মাসের মাথায় তাঁর হয়ে আমরা আজ আওয়াজ তুলছি।’’ শহরের বিভিন্ন প্রান্তের রাজপথে রাত-জাগা মানুষেরাও দাবি করলেন, রাস্তা থেকে লেখা-ছবি মুছে গেলেও আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদ কোনও দিন মন থেকে মুছবে না। রাত ৯টা নাগাদ ‘যাদবপুর আর্টিস্টস ফোরাম’-এর মিছিল শুরু হয়েছিল গড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে। অংশগ্রহণকারীদের কেউ রং-তুলি দিয়ে রাস্তায় লিখলেন, ‘তিলোত্তমার ভয় নেই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’’ কেউ লিখলেন ‘‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।’’ আবার কেউ লিখলেন ‘‘তিলোত্তমার রক্তচোখ, আঁধার রাতের মশাল হোক।’’
মিছিল দেখতে আসা সাধারণ মানুষও কোথাও কোথাও যোগ দিলেন সেই কর্মসূচিতে। গড়িয়া ৪৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে দেখা গেল, বছর দশেকের এক কিশোরী বাবার হাত ধরে রাস্তায় আঁকা একটি আগুনের শিখায় লাল রং করছে। তখন রাত প্রায় ১২টা। মিছিল এগোচ্ছে বাঘা যতীনের দিকে। রাস্তার ধারে দাঁড়ানো পিয়ালি দাশের আফশোস, ‘‘ভেবেছিলাম যে শুধু মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা আঁকতে পারবেন। কিন্তু এখন সকলকে আঁকতে দেখে ভাবছি বাড়ি থেকে রং-তুলি আনলে ভাল হত।’’ সেই কথা শুনে এক মহিলা এগিয়ে এসে ওই তরুণীর হাতে তুলে দিলেন ছবি আঁকার উপকরণ।
একই রকম ভাবে আর জি করের আন্দোলন মঞ্চে ‘লাইভ পেন্টিং’ করলেন আবাসিক চিকিৎসক রিয়া বেরা। আবার, এক দল তরুণী আবাসিক চিকিৎসক মঞ্চের সামনের চত্বরে সাদা-লাল রং ব্যবহার করে আঁকলেন দুর্গার ত্রিনয়ন। যার তিনটি ফলার দু’টি হল স্টেথোস্কোপ। আর তিনটি চোখ ব্যবহার করে লেখা হল, ‘অভয়া’। ওই রাতে ১২টা থেকে আর জি করে শুরু হয়েছিল ‘অভয়ার রাত’ কর্মসূচি। আন্দোলন মঞ্চে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার প্রতীকী ছবি সাজানো হল সাদা ফুলে। তার পরে ১৪ অগস্ট রাতে যে জরুরি বিভাগে ভাঙচুর করা হয়েছিল, সেখানে প্রবেশের ঢালু রাস্তায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে লেখা হল, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। জ্বালানো হল ১০০টি প্রদীপ। এর পরে আন্দোলন মঞ্চে স্বরচিত গান ধরলেন কয়েক জন আবাসিক চিকিৎসক। কেউ আবার পাঠ করলেন কবিতা।
এমন ভাবেই রাত জাগার মাঝে আন্দোলনের এক মাসের বিভিন্ন ঘটনার কোলাজ নিয়ে বানানো ৩০ মিনিটের ভিডিয়ো প্রদর্শিত হল আর জি করে। সেখানে সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগ ও গ্রেফতার দেখানোর সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠল। আবার প্রায় ২২ ঘণ্টা পরে জুনিয়র চিকিৎসকদের লালবাজারে প্রবেশ করতে পারার সাফল্যের ছবি পর্দায় ফুটে উঠতেই হাততালিতে ভরে উঠল গোটা আন্দোলন মঞ্চ। তাঁদের সঙ্গে ষাটোর্ধ্ব বিপাশা লাহিড়ী, রানাঘাটের চা বিক্রেতা ভোলা চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতীর পড়ুয়া বাসুদেব চক্রবর্তীরাও রাত জাগলেন আর জি করে। বিপাশা বললেন, ‘‘এক মাস আগের সেই রাত! আজ কি বাড়িতে ঘুম আসে? তাই চলে এসেছি।’’