মর্মান্তিক: উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরে চলছে উদ্ধারকাজ। ফাইল চিত্র।
কখনও চার্জশিটের লাইন তুলে আপত্তি জানিয়ে নতুন প্রতিলিপি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন অভিযুক্তেরা। কখনও বলছেন, প্রতিলিপি এতই আবছা যে লেখা পড়া যাচ্ছে না! নতুন প্রতিলিপি না পেলে শুনানিতে থাকা সম্ভব নয়। আবার কখনও শুনানিতে অভিযুক্তদের এক জন এলে, আসছেন না অন্যেরা। অভিযোগ, এই অবস্থায় গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে রয়েছে পোস্তা উড়ালপুল-কাণ্ডের বিচারপর্ব। আদালত সূত্রের খবর, সামগ্রিক জটিলতায় চার্জ গঠনই করা যায়নি।
এ দিকে, আগামী সপ্তাহেই পোস্তা উড়ালপুলের অবশিষ্ট অংশ ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হবে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। সূত্রের খবর, মুম্বইয়ের যে সংস্থা মাঝেরহাট সেতু ভেঙেছিল, তারাই পোস্তা উড়ালপুল ভাঙার কাজ করবে। কিন্তু তার মধ্যে কি চার্জ গঠন হওয়া সম্ভব? মামলার তদন্তকারী আধিকারিক তথা বর্তমানে নিউ আলিপুর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বললেন, “কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। মামলার পরবর্তী শুনানি অগস্টে। তখনও ১৭ জন অভিযুক্তকে একসঙ্গে উপস্থিত করানো যাবে কি না সন্দেহ।”
২০১৬-র ৩১ মার্চ পোস্তার বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের একাংশ ভেঙে ২৭ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৮০ জনেরও বেশি। নানা মহলে সমালোচনার মুখে পড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে খড়্গপুর আইআইটি-র তিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এবং তৎকালীন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়া হয় তদন্ত কমিটি। উড়ালপুলের নির্মাণ সংস্থা, হায়দরাবাদের আইভিআরসিএল-এর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা রুজু হয়। দু’বছর পরে জমা দেওয়া রিপোর্টে তদন্ত কমিটি জানায়, উড়ালপুলের নকশা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ-ও জানানো হয়, উড়ালপুল তৈরির মশলা ও অন্যান্য সরঞ্জামের গুণগত মান নির্দিষ্ট সময় অন্তর যাচাই করা হয়নি। তাই উড়ালপুলের অবশিষ্ট অংশ ভেঙে ফেলার সুপারিশ করে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর পরে মুম্বই থেকে বিশেষজ্ঞদের এনে পরামর্শ চায় কেএমডিএ। তাঁরাও সেটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেন।
এর পাশাপাশি, রাইটস, খড়্গপুর আইআইটি-সহ একাধিক বিশেষজ্ঞ সংস্থা উড়ালপুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছিল। সব শেষে সেতু বিশেষজ্ঞ ভি কে রায়নাকে দিয়ে উড়ালপুলটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। তিনিও কাঠামো ভেঙে ফেলার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন।
তবে উড়ালপুল ভাঙার পরে সেখানে কী করা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী উড়ালপুলের কাঠামো ভাঙা হবে। তার পরে সরকার পরবর্তী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে।’’
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, উড়ালপুল ভাঙার সিদ্ধান্ত এত দীর্ঘ হওয়ার চেয়েও দীর্ঘতর হয়েছে বিচার প্রক্রিয়া। পুলিশের দাবি, ২০১৬ সালেই চার্জশিট দেওয়া হয়। আইভিআরসিএল-এর আধিকারিক-সহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করে বিশেষ তদন্তকারী দল। পরে গ্রেফতার করা হয় আরও পাঁচ জনকে। যদিও ধৃতেরা এখন জামিনে রয়েছেন। ওই তদন্তকারী দলের মূল অফিসার জানান, চার্জশিটে আইভিআরসিএল-এর ১০ জনের নাম ছাড়া কেএমডিএ-র দু’জন, ‘ইকিউট’ নামে একটি ডিজ়াইনিং সংস্থার দু’জন এবং অনিন্দিতা এন্টারপ্রাইজ় নামে যে সংস্থাটি উড়ালপুলে ঝালাইয়ের কাজ করেছিল, তাদের দু’জনের নাম রয়েছে। আইআর ক্লাস নামে একটি সংস্থাও উড়ালপুল নির্মাণে যুক্ত ছিল। তাদেরও এক জনের নাম রয়েছে।
গত পাঁচ বছরে অবশ্য অভিযুক্তদের সকলকে কখনওই আদালতে হাজির করানো যায়নি। কেউ প্রতিলিপির ভাষা নিয়ে, কেউ কেউ ছাপার অক্ষর বুঝতে না পারার কারণ দেখিয়ে শুনানি এড়িয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশ্ন, অবশিষ্ট উড়ালপুল ভাঙার সময় হয়ে গেলেও কেন শুরু হল না বিচার? মামলার সরকারি আইনজীবী তমালকান্তি মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমরা চাই, দ্রুত কাজ এগোক। তবে অনেক কারণে দেরি হচ্ছে। কিন্তু দোষীরা সাজা পাবেই।”