—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
৯ অগস্ট ঘটনা প্রকাশ্যে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তের যতটুকু অগ্রগতি জানা গিয়েছিল, গ্রেফতারির সংখ্যা যা ছিল, তিন সপ্তাহ পরে তার থেকে এগোনো গিয়েছে কতটা? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সাধারণ মানুষের বড় অংশ এই ঘটনার রাজনীতিকরণে যতটা বীতশ্রদ্ধ, ততটাই হতাশ স্পষ্ট উত্তর না পাওয়ায়। তাঁরা বলছেন, তদন্তের কোনও অগ্রগতি সামনে আসছে না কেন?
আগামী মাসের শুরুতে এই মামলার শুনানি রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। তত দিনে কি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে নতুন কোনও তথ্য জানা যাবে? মৃতার মা এ দিন বললেন, “বিচার পাওয়া তো দূর, কিছু জানতেই পারছি না। বরং ভাবতে বসলে আরও অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি। যাতে মনে হচ্ছে, আমার মেয়ের খুন এক জনের কাজ নয়। কেন সিবিআই-ও কিছু নির্দিষ্ট ভাবে প্রকাশ করতে পারছে না, সেই উত্তর চাইছি। প্রয়োজনে নিজে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হব। মেয়ের মৃত্যু ঘিরে যে যে প্রশ্ন আমার মনে আছে, তার উত্তর চাইব।”
আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি, যে কোনও ঘটনা কোথায় হয়েছে আর কী ভাবে হয়েছে, সেটাই তদন্তের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় প্রাথমিক ভাবে। তার পরে আসে কেন এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেই প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে খুন এবং ধর্ষণ কোথায় হয়েছে আর কী ভাবে হয়েছে, সেই প্রাথমিক প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি। এখনও পর্যন্ত এই মামলার সঙ্গে জড়িত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ— ফরেন্সিক পরীক্ষার সমস্ত রিপোর্টই এসে পৌঁছয়নি বলে সূত্রের খবর। এক জন গ্রেফতার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার শরীরের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টও পাওয়া যায়নি।
এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলার সঙ্গে জড়িত রিপোর্ট কি চাইলে আগে বার করতে পারে না তদন্তকারী সংস্থা? দীর্ঘদিন কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করা, বর্তমানে দিল্লিতে একটি তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক বললেন, “এই খুন এবং ধর্ষণের মামলা তো অনেক বড় ব্যাপার। পুলিশ মনে করলে যে কোনও মাঝারি মাপের মামলার রিপোর্টও আগে চেয়ে নিতে পারে। আদালতে আবেদন করেও রিপোর্ট বার করিয়ে আনার পথ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পুরোটাই তদন্তকারী সংস্থার সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে।”
এর মধ্যেই মৃতার পরিবার এ দিন ফের প্রশ্ন তোলে, হাসপাতালের সেমিনার রুম-ই ঘটনাস্থল কি না, সে ব্যাপারে। তরুণীর মা বলেন, “আমরা যখন গিয়েছি, তখন মেয়ের মৃতদেহের উপর সবুজ চাদর ছিল। পরে ডাক্তার পড়ুয়ারা যা দেখিয়েছেন, তাতে মেয়ের মৃতদেহের উপরে নীল চাদর। পুলিশ বলছে, মেয়ে লাল কম্বল নিয়ে ঘুমচ্ছিল। সত্যি কোনটা?” সিবিআই সূত্রে এ ব্যাপারে কোনও তথ্য প্রকাশ করা না হলেও কলকাতা পুলিশ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, লাল কম্বল নিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন তরুণী। পরে সেই কম্বল তরুণীর পাশ থেকে উদ্ধার হয়। মৃতদেহ প্রথম ওই অবস্থায় দেখে হাসপাতালের এক চিকিৎসক চাদর ঢাকা দিয়ে দিতে বলেন। তখনই নীল চাদর দেওয়া হয়। ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে এ দিন দাবি করেন, “তদন্তের সময় ফোটোগ্রাফি করা হয়েছিল। সেই সময়ে, ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহ করার সময়ে এবং সিজ়ার তালিকা তৈরি করার সময়ে একটাই রং পেয়েছি আমরা। সেটা নীল।”
যদিও ‘ঘটনাস্থলের চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে’ বলে যে অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা করেছিলেন, সেই অভিযোগ সংক্রান্ত কোনও তদন্ত হয়েছে কি না, আর তা হয়ে থাকলে কী পাওয়া গিয়েছে, সেই সংক্রান্ত তথ্যও এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
ময়না তদন্ত নিয়ে একাধিক প্রশ্ন ওঠার পরে অনেকে এ-ও জানতে চান, কেন তরুণীর মৃতদেহ তড়িঘড়ি দাহ করে ফেলা হল? আর জি করেই চার ডিগ্রি সেলসিয়াসে মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখার পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন তা করা হয়নি, সেই প্রশ্ন এখন তুলছে মৃতার পরিবারও। এর পরেই এ দিন সিবিআইয়ের তদন্তকারী দল আর জি করে মর্গে গিয়ে খুঁটিনাটি বিষয় খতিয়ে দেখেন। সূত্রের খবর, ২০২১ থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত আর জি করে যত ময়না তদন্ত হয়েছে, সেই সম্পর্কিত রিপোর্ট সংগ্রহ করে সিবিআই। ডেকে পাঠানো হয় হাসপাতালের নতুন সুপার সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়কে। মর্গে দেহ আনার পরে কোথায় ব্যবচ্ছেদ করা হয়, কতগুলি চেম্বার রয়েছে, সেগুলি কী ভাবে কাজ করে— এই সমস্ত বিষয় জানার পাশাপাশি মর্গের শব ব্যবচ্ছেদের ঘরের নকশা, ঘরের মাপ খতিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা। কোনও মৃতদেহ আনার পরে এবং ব্যবচ্ছেদের পরে কী ভাবে সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করা হয়, তা নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয় সুপারের কাছ থেকে। পরে বেরিয়ে সপ্তর্ষি বলেন, “আমিও ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তাই আমাকে ডাকা হয়েছিল, বিষয়গুলি জেনে নিতে।”
প্রশ্ন রয়েছে শ্মশানে দাহকাজের সময় কাগজপত্রে এক রাজনৈতিক নেতার সই নিয়ে। শ্মশানের এক কর্মী দাবি করেছেন, তরুণীর দেহের আগে আরও দু’টি মৃতদেহ ছিল। তরুণীর দেহ তাদের আগে দাহ করার জন্য ওই নেতা কোনও ভূমিকা পালন করেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। প্রশ্ন রয়েছে, তরুণীর মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরির পাতা নিয়ে। পুলিশ সূত্রে দাবি, তাতে লেখা ছিল, ‘এমডি গোল্ড মেডেলিস্ট হতে চাই। বাবা মা-কে দেখতে হবে আমাকেই’। আরও একটি কাগজের উপরে কিছু লিখে কালো কালি দিয়ে কেটে রাখা ছিল। মৃতের পরিবার এবং আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের প্রশ্ন, মৃত্যুর আগে ওই রাতেই তরুণী এত কথা লিখে রাখলেন? তারপর তা মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধারও হল অবিকৃত অবস্থায়? ধর্ষণ, খুনের ঘটনায় যে ধস্তাধস্তির চিহ্ন সাধারণত থাকার কথা, তা থাকল না?