Street Dog

লিসা খুঁজে ফেরেন অসুস্থ সারমেয়, ‘ভাইটু’কে হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে ব্যথা সারান পথ-শাবকদের

নিজের প্রিয় সারমেয়কে হারিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তার পরে বাড়িতে নতুন পোষ্য এসেছে। কিন্তু সেই হারানোর সময়ে যে ব্রত নিয়েছিলেন, তিনি তাতে এখনও অবিচল।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০৯
Share:

ব্যথা কমাতেই ব্যথা সারান লিসা দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।

ভরদুপুরের ব্যস্ত সময়। মধ্য কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট লোকারণ্য। তারই মধ্যে এক যুবতী তিন চাকার ভ্যান রিক্সার তলায় শুয়ে-থাকা কুকুরটির পা ধরে টানছেন। পথচলতি কৌতূহলী মানুষ অনেকে দাঁড়িয়েও পড়েছেন। ব্যাপারটা কী? কুকুরটি বার হতে নারাজ। কিন্তু যুবতী নাছোড়। শেষে হার মানল কুকুরটিই। ঘাড়ের কাছে তার গভীর ক্ষত, ঘা হয়ে গিয়েছে। চারপাশে আরও কিছু ক্ষতচিহ্ন। ভন্‌ভন্‌ করছে মাছি। যুবতী যত্ন করে ওষুধ স্প্রে করে দিতে থাকলেন সেই সব ক্ষতস্থানে। কিছু ক্ষণ পর কাজ শেষ করার তৃপ্তি নিয়ে হাতে স্যানিটাইজার মাখছেন যখন, তখনই কথা হল, লিসার সঙ্গে। জানা গেল, দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার লিসা দত্ত কয়েক দিন ধরে রোজই আসছেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। নাম না-জানা সাদা কুকুরটাকে সুস্থ করতে হবে। রোজ ওষুধ দিতেই হবে।

Advertisement

লিসার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করতেন। অবসর নিয়েছেন। বাড়িতে দিদি ছিলেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে ২০১৭ সালে। বছরটা লিসার বড্ড একা হয়ে যাওয়ার বছর। দিদি শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল। আর ভুল চিকিৎসায় মারা গেল আদরের সাহেব। সাহেব ছিল ল্যাব্রেডর প্রজাতির কুকুর। লিসা ওকে ‘ভাইটু’ বলে ডাকতেন। এখনও ভাইফোঁটা দেন সেই ভাইটুকে। রাখি পরান ছবিতে। বাড়িতে এখন দুষ্টু (গোল্ডেন রিট্রিভার) এসেছে। কিন্তু সাহেব চলে যাওয়ার পরে যে কষ্টটা পেয়েছিলেন, সেটা পূরণ করতে লিসা অন্য এক শপথ নিয়ে নেন।

সাহেব আজও লিসার ‘ভাইটু’। —নিজস্ব চিত্র।

সাহেবকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সেই কথা বলতে বলতেই লিসা জানান, ‘‘আমার বাড়িতে এত যত্নে থেকেও ওকে বাঁচানো যায়নি। দুষ্টুর যত্ন নিই। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় কত বাচ্চা রয়েছে যাদের চিকিৎসা দরকার। আমি এখন সেই বাচ্চাদের চিকিৎসার চেষ্টা করি।’’ প্রসঙ্গত, গোটা কথোপকথনের সময়ে লিসার মুখে একটি বারের জন্যও ‘কুকুর’ বা ‘সারমেয়’ শব্দ শোনা যায়নি। ওঁর কাছে রাস্তার ওরা সকলেই ‘বাচ্চা’।

Advertisement

এমন অনেক বাচ্চা লিসার। বললেন, ‘‘আমি তো একসঙ্গে অনেক কিছু করতে পারব না। তাই একটা বাচ্চাকে সুস্থ করার পরে অন্য এক জনের কাছে যাই। রাস্তাঘাটে ঠিক পেয়ে যাই কাউকে না কাউকে। এখন যেমন এই বাচ্চাটির দেখাশোনা করছি। ওর কোর্সটা কমপ্লিট হলে এর পরে আমায় দেশবন্ধু পার্কের ওখানে একটা বাচ্চার উপরে নজর দিতে হবে।’’ নিজের পাড়াতেও বেশ কয়েকটি এমন বাচ্চার দেখাশোনা করতে হয়। কাউকে কাউকে হাসপাতালেও দিয়ে এসেছেন। লিসা বলেন, ‘‘ক’দিন আগেই একটা বাচ্চার চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝলাম আমি পারব না। এখন তাকে একটা হাসপাতালে দিয়ে এসেছি। নিয়মিত খবর নিই। ভাল আছে।’’

বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সাদা কুকুরটার সঙ্গে লিসা। —নিজস্ব চিত্র।

ছোট থেকেই কুকুরের সংস্পর্শে। তাই কেমন ঘা হলে কী ওষুধ দিতে হবে তার প্রাথমিক জ্ঞান লিসার রয়েছে। অসুবিধায় পড়লে তিনি ছবি তুলে পরিচিত চিকিৎসকদের দেখিয়ে পরামর্শ নিয়ে নেন। এই ভাবেই চলছে তাঁর বাচ্চা-সেবা। বললেন, ‘‘এইখানটায় কয়েক দিন ধরেই আসছি। প্রথম প্রথম বাচ্চাটা আমায় দেখলে পালাত। এখন ও নিজেও বুঝতে পারছে ওষুধে কাজ হচ্ছে। আগের মতো জ্বালায় না। তবে একটু সাধাসাধি করতে হয়। আসলে ওষুধ খেতে বা লাগাতে তো সব বাচ্চাই আপত্তি করে বলুন!’’ তবে লিসার এই চিকিৎসার সময় একটা সমস্যা হল ভিড়। ওষুধ লাগানোর সময় তাঁকে বন্ধু ভাবলেও, কুকুরেরা যে ভিড়কে ভয় পায়!

মাঝেমাঝে সেইখানটাতেও যান। নেতাজিনগর কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক লিসা চলে যান যেখানে ওঁর প্রিয় সাহেব চিরকালের জন্য শায়িত। সাহেবের কথা ভুলতে পারেন না কিছুতেই! লিসা বললেন, ‘‘ওঁরা তো কথা বলতে পারে না। এটাই সবচেয়ে কঠিন। ওঁদের কষ্ট বোঝাটাই মুশকিল। সাহেব যদি আগে থেকে ওর কষ্টের কথা বলত তবে হয়তো আরও আগে চিকিৎসা শুরু হত। চিকিৎসায় ভুল হচ্ছে সেটাও তো আমরা বুঝিনি। তা হলে ভাইটুকে এত তাড়াতাড়ি হারাতে হত না।’’

তবে অতীত বুকে জমা থাকলেও তা নিয়ে ঘরে বসে থাকার পাত্রী নন লিসা। চলে যাওয়ার আগে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলে গেলেন, ‘‘কাল আসব। আমায় দেখলেই কাছে চলে আসবি। দুষ্টুমি করবি না কিন্তু একদম!’’ সাদা কুকুরটা কী বুঝল কে জানে, ল্যাজটা একটু উপর দিকে তুলে নেড়ে দিল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement