Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: দু’চাকার পুষ্পক রথ

সাইকেলে সওয়ার হয়ে ইনি প্রথম বিশ্বভ্রমণ করেছেন, সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা শুরু ১৮৮৪-র ২২ এপ্রিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৫:৪৫
Share:

সাইকেল নিয়ে নানান কসরত দেখাতে ভালবাসত সাউথ সুবার্বান স্কুলের ছাত্রটি। গৃহশিক্ষকের বাড়ির পথে একটা চওড়া নালা, উপরে কাঠের সরু পাটাতন। তার উপরেই সাইকেল চালাতেন শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, কাঁধে তুলে নিতেন সহপাঠী প্রেমেন্দ্র মিত্রকে! ঘনাদা-স্রষ্টা লিখছেন: “তখনকার দিনে ও বয়সের ছেলের সাইকেল চড়াটাই একটা বাহাদুরি। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট থাকবার পাত্র সে মোটেই ছিল না।” হ্যারিসন রোডে সাইকেলের দোকান খুলেছিলেন ‘কুন্তলীন’খ্যাত হেমেন্দ্রমোহন বসু। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু, সস্ত্রীক নীলরতন সরকার, অকৃতদার প্রফুল্লচন্দ্রকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছেন তিনি, ভোরের কলকাতায়, মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে। উৎসাহী জগদীশচন্দ্র লিখছেন: ‘বাইসিকেল আমাদের পুষ্পক রথ।’

Advertisement

১৮৮৬-র ১৩ সেপ্টেম্বর টমাস স্টিভেন্সকে নিয়ে রীতিমতো শোভাযাত্রা করেছিল কলকাতাবাসী। কে এই টমাস? সাইকেলে সওয়ার হয়ে ইনি প্রথম বিশ্বভ্রমণ করেছেন, সানফ্রান্সিসকো থেকে যাত্রা শুরু ১৮৮৪-র ২২ এপ্রিল। বাঙালিদের মধ্যে সাইকেলে প্রথম ‘দিগ্বিজয়ী’ বিমল মুখোপাধ্যায়ের বই দুচাকায় দুনিয়া জনপ্রিয় আজও। সাইকেলে তিন বার ভূপর্যটনকারী রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনি আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত হত ধারাবাহিক ভাবে। বিমল দে-র লেখা সুদূরের পিয়াসী ভ্রমণ-সাহিত্যের এক সাইকেল-কাহিনিরত্ন।

কল্লোল পত্রিকায় বেরিয়েছিল সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প দা-গোঁসাই। বিস্মৃত এই লেখককে নিয়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মন্তব্য: ‘ঢাকে যেমন কাঠি, তেমনি তার সঙ্গে সাইকেল।...সন্দেহ হয় সে সাইকেলেই বোধহয় ঘুমোয়, সাইকেলেই খায় দায়।” কন্যা মহাশ্বেতাকে কিশোরীকালে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন মণীশ ঘটক, পিতা-পুত্রী দু’টি সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন। পঞ্চাশের মহামন্বন্তরে মহাশ্বেতার ‘কিশোর বাহিনী’র কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল এই সাইকেল।

Advertisement

সাইকেল ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের, চিত্রকর জয়নুল আবেদিনের। আত্মচরিতের খসড়া-য় অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, “সাইকেল আমার ছিল মুক্তির একটি বাহন— নিজের একটি নতুন দ্বিচক্র ছিল, অন্যেরও ব্যবহার করেছি, দূরে দূরে চলে যেতাম।” সুনির্মল বসুর লেখা দু’টি লাইন: “বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল,/ যেওনা যেওনা সেথা যেথা চলে সাইকেল।” গৌরাঙ্গ প্রেসের দেওয়া সাইকেলে টালা, শ্যামবাজার, এসপ্ল্যানেড, লিলুয়া যেতেন বাদল বসু, লেখার প্রুফ পৌঁছতে। সেই সাইকেলের ব্যাটারিচালিত হর্নের পিঁ-পিঁ শব্দে পাড়ার ছেলেরা তাঁকে বলত ‘বোম্বাই মেল’! স্বদেশি দল ‘জয়শ্রী পার্টি’-র সৌজন্যে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সঙ্গ করা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে মাঝেই সাইকেলে বেরোতেন বিপ্লবীর সঙ্গে। ৩ জুন চলে গেল বিশ্ব সাইকেল দিবস, আজ পরিবেশ দিবসে পরিবেশবন্ধু এই যানটিই লকডাউনের শহরে প্রিয় সঙ্গী। রেলস্টেশন লাগোয়া, নিত্যযাত্রীদের সাইকেল স্ট্যান্ডগুলোই শূন্য শুধু।

স্মারক গ্রন্থ

মহানগরের তিনশো বছর পূর্তির আবহে কলকাতার ইতিহাস চর্চা প্রাণবান হয়েছিল আশির দশকে, জোয়ার এসেছিল হাওড়ার ইতিহাস চর্চাতেও। ‘হাওড়া জেলা ইতিহাস প্রণয়ন, উন্নয়ন ও স্মারক সমিতি’ গড়ে উঠেছিল যে মানুষটির নেতৃত্বে, তিনি অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২০-২০০৩) (ছবিতে)। বাংলা সাহিত্য ও তার ইতিহাসে ডুবে থাকা মানুষটি সমান নিষ্ঠায় লিখেছেন হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত-র মতো গ্রন্থ, দিয়েছেন ভবিষ্যপথের হদিস। করোনাকালে তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর, ৩ জুন চলে গেল আর একটি জন্মদিন। হাওড়া চর্চা নামে ‘অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ’ (সম্পাদনা: কল্যাণ দাস ও সন্দীপ বাগ) প্রকাশ করেছে ‘অমর ভারতী’, সেখানে আচার্যের স্মৃতিচারণ, জীবনকৃতির রূপরেখার পাশে এখনকার গবেষকরা ছুঁয়েছেন হাওড়ার আঞ্চলিক ইতিহাসের দিগন্তরেখা।

ছবির ভুবন

কখনও পর্দায় উঠে এসেছে শম্ভু মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধানের জীবনকৃতি। কখনও বিষ্ণুপুরের সুপ্রাচীন ধ্রুপদ ঘরানা-কথা, কিংবা যূথিকা রায়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সুবীর সেনের অনন্য গায়নে বাংলা গানের এক সোনালি অধ্যায়। শিল্পীর ব্যক্তি-পরিসর পেরিয়ে শিল্পের বিরাট বৃত্তকেও ছুঁয়ে দেখা— বাংলার ঢেঁকির গান, নাটুয়া নাচ, পশ্চিম মেদিনীপুরের পাথরের লোকশিল্প, উত্তরবঙ্গের নেওয়ার জনগোষ্ঠীর লোকনৃত্য বা মাসান দেবশিল্পকথা। তারই পাশে সিকিমের ঐতিহ্যবাহী লামা নাচ, লেপচাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সন্ধান। ‘পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র’ আয়োজিত ‘অনলাইন আর্কাইভ ডকুমেন্টারি ফেস্টিভ্যাল’ শেষ হল সম্প্রতি, ছবিগুলি দেখার সুযোগ এখনও— ‘ইস্টার্ন জ়োনাল কালচারাল সেন্টার, কলকাতা’-র ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।

সীমান্তবিহীন

“যে-দেশের হাওয়ায় মাটিতে জলে গোটা কৈশোর কেটেছে, সেই দেশই তো আমার।” বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ২০১৯-এ ঢাকায় একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনে। সেই অভিভাষণ দিয়েই শুরু হয়েছে আরম্ভ পত্রিকার (সম্পাদক বাহার উদ্দিন) শঙ্খ ঘোষ স্মরণ সংখ্যা ‘সীমান্তবিহীন’। মুখবন্ধে লেখা: “শঙ্খদার দিনযাপন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, অন্যকে জানো, অন্যের কথা বলো আপনকে আড়াল করে।” ডিজিটাল এ সংখ্যায় আছে ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য, গৌতম ঘোষ, শুভাপ্রসন্ন, মোফাখখারুল ইকবাল, বিমান বসু প্রমুখের লেখা। ফিরহাদ হাকিম লিখেছেন: “ভালো কাজ করলে প্রশংসা করতেন, সংযত ভাষায়। আবার অন্যায় করতে থাকলে ছেড়ে কথা বলতেন না। হাতে হাত রেখে বিরোধিতা করতেন।”

উত্তরাধিকার

বিশ্বভারতীর নিয়ন্ত্রণবিধি উঠে যাওয়ার পর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে যে পরীক্ষা ও প্রসারণ চলছে, যথার্থ উত্তরাধিকার কি রক্ষিত হচ্ছে তাতে? রবীন্দ্রসঙ্গীত সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়ে প্রসাদ সেন স্থাপিত সঙ্গীত সংস্থা ‘সোহিনী’র উদ্যোগে গত ১৭ মে সন্ধ্যায় হয়ে গেল আন্তর্জাল-আলোচনা, সত্যকাম সেনের সঞ্চালনায় সেখানে বললেন পীতম সেনগুপ্ত, মানস মুখোপাধ্যায়, স্বপন সোম, পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত সংরক্ষণে স্বরলিপিকারদের অবদান, ইউরোপীয় ঘরানা ও স্বকীয় ধরনের মিশ্রণে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রসঙ্গীতের একান্ত নিজস্ব রূপ ধরে রাখার পথে বাধা, দুরূহ গানের অতিসরলীকরণ, শান্তিনিকেতনে গানের পরিবেশন-সৌকর্যের পরম্পরা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিজিটাল সংরক্ষণ নিয়ে কথা হল। ‘সোহিনী’-র ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে অনুষ্ঠানটি।

করোনায়িত

করোনা-কালে কী ভাবে খাবারের হোম ডেলিভারি হচ্ছিল, কাগজে প্রকাশিত তার প্রথম বিজ্ঞাপনটি: “আমাদের সেফ ডেলিভারী এক্সপার্ট পৌঁছে আপনার দরজার সামনে একটি ক্যারি ব্যাগের মধ্যে পিৎজা রেখে যাবে। তারপরে পিছিয়ে গিয়ে এক নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি আসছেন।” বা গুঁড়ো সাবানের বিজ্ঞাপনে নিরাপদে থাকতে বলার মধ্যেও আবছা অক্ষরে মনে করিয়ে দেওয়া পণ্যটির নাম... এ সব নমুনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা: ‘করোনার টাইমে একেই বলে সার্থক ক্যামোফ্লেজড বিজ্ঞাপন।’ হরপ্পা প্রকাশ করেছে বৈদ্যুতিন পুস্তিকা করোনায়িত বাণিজ্য: বিজ্ঞাপনের দিনলিপি, কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের লেখায়, সোমনাথ ঘোষের অলঙ্করণে, শ্লেষ-হিউমার-বিশ্লেষণে মোড়া।

পুরানো সেই

১৭৩৭ সালের ১১ অক্টোবর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী ছিল কলকাতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘কলকাতা কাউন্সিল’-এর সদস্য স্যর ফ্রান্সিস রাসেলের চিঠিতে আছে, সে রাতে তাঁর পাকা বাড়িও প্রায় ভেঙে পড়ছিল ঝড়ের দাপটে। প্রতিবেশী ক’জনের বাড়ির দরজা জানালা ঝড়ে উড়ে গেলে তাঁরা আশ্রয় নেন সাহেবের বাড়িতে। নদীর ধারে নোঙর করে রাখা নৌকা ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়েছিল আজকের ক্রিক রো অঞ্চলে, যা থেকে জায়গাটির নাম হয় ডিঙাভাঙা। সেন্ট অ্যান’স গির্জার চূড়া, কুমোরটুলিতে গোবিন্দরাম মিত্রের বিশাল মন্দিরও ভেঙে পড়েছিল ঝড়ে। ১২৭ বছর পর, ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বৌবাজারের রোমান ক্যাথলিক গির্জা, ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ। জলোচ্ছ্বাসে স্ট্র্যান্ডের উপর দিয়ে বয়েছিল গঙ্গার স্রোত। নদীর ধারে নোঙর করা জলযানগুলির ধ্বংসাবশেষ ভাসতে দেখা গিয়েছিল পরের সকালে। ক্ষয়ক্ষতির যে ছবি তোলা হয়েছিল, তা থেকে তৈরি এনগ্রেভিং-সহ ঘটনার বিবরণ ছাপা হয়েছিল দি ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ় পত্রিকায়। ধ্বংসের পাশাপাশি সেখানে ফের জীবন শুরুর উদ্যম (নীচের ছবিতে)। ‘ইয়াস’-এর আবহে সম্প্রতি ফিরে এসেছিল পুরানো সেই ঝড়ের কথা।

নজরকাড়া

বাংলা সাহিত্যের কোনও কাল্পনিক চরিত্রকে নিয়ে এই প্রথম তৈরি হল ‘ফ্যাক্ট বুক’, পাঠক চাইলে ব্যবহার করতে পারবেন ডায়রি হিসেবেও। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘ভাষা ক্লাসিক’ প্রকাশ করেছে অভিনব ফেলুদা টু ইন ওয়ান। অনেকগুলো পাতা সেজে উঠেছে ফেলুদাকে নিয়ে জানা-অজানা তথ্যে, অগ্নিভ চক্রবর্তীর সঙ্কলন ও সম্পাদনায়। তরুণ শিল্পী কামিল দাসের আঁকা ‘ফেলুদা ফ্যান আর্ট’-এর নমুনা অনেকগুলো পাতায়, বাকি সাদা অংশ পাঠকের জন্য ছেড়ে রাখা— আঁকা-লেখা যাবে নিজের ইচ্ছেমতো, যা খুশি। এই ফেলুদা ফ্যাক্ট বুক-কাম-ডায়েরির অন্যতম আকর্ষণ সন্দীপ রায়ের ‘স্পেশাল ফেলু ফ্যাক্ট’। সুন্দর বাঁধাই, ম্যাগনেটিক লক-এর ব্যবহারে এই ফ্যাক্ট বুক ফিটফাট স্মার্ট, ফেলুদার মতোই। সঙ্গে ফেলুদার প্রিয় চারমিনার সিগারেটের স্মারক গিফ্ট প্যাক, ফেলুদা ফোন স্টিকারও। ফেলু-ভক্তকুলের মন কাড়তে বাধ্য। ছবি ফ্যাক্ট বুকের প্রচ্ছদ থেকে।

প্রদীপশিখা

করোনা-ঝড়ে প্রতিদিন চেনা-অচেনা কত মানুষের জীবনদীপ নিভে চলেছে, তার মধ্যেই বাংলার মননজগতের অন্যতম উজ্জ্বল দীপশিখাটি নিভে গেল গত ২৯ মে, সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপকুমার বসুর আকস্মিক প্রয়াণে। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও, নির্দিষ্ট কোনও বিষয়শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলা যায় না তাঁকে— স্নাতকোত্তরে দর্শনশাস্ত্র চর্চার পর গবেষণা করেছিলেন সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের মতো পরিসরে। পশ্চিমি ধ্রুপদী সঙ্গীতেও ছিল অগাধ জ্ঞান। আর ছিল তীক্ষ্ণ এক রসবোধ, আজীবন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement