বাজারের দরজা খুলল ১ জানুয়ারি, ১৮৭৪। যে সে বাজার নয়, এ দেশে পৌরসভার উদ্যোগ ও বিনিয়োগে স্থাপিত প্রথম বাজার। ১১ এপ্রিল লেফটেন্যান্ট গর্ভনরের গর্বিত দাবি, বাজারের চেহারাটা হয়েছে চমৎকার, এই শহরে এমন বাজারই মানায়, তাই প্রশাসনেরও তাকে ঢেলে সাহায্য করা উচিত। এই বাজার মানে, এখনকার ‘নিউ মার্কেট’।
যে কোনও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মতোই, নিউ মার্কেটও এক বিশেষ সময় ও সমাজের ভাবনার ফল। উনিশ শতকের কলকাতায় সাহেব রাজপুরুষদের বাজার হিসেবে প্রথম থেকেই এর স্থাপত্য ও নির্মাণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি বাঁধা ছিল উঁচু তারে। বাজারের নকশার জন্য আহ্বান করা প্রতিযোগিতায় জিতে নগদ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের স্থপতি রিচার্ড রসকেল বেন। অনেকে তাই নিউ মার্কেটের মধ্যে এক ভিক্টোরীয় রেলস্টেশনের আদল পান। ২,৫৮,৭২০ টাকা মূল্যে এই বাজার নির্মাণের বরাত পায় মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। বেন সাহেবের নকশায় বাজার সেজে উঠল লাল ও হলুদ ইটের দেওয়ালে গড়া গথিক শৈলীর সঙ্গে মাননসই উপাদানে— অলঙ্কৃত সম্মুখভাগ, খড়খড়ি দেওয়া খিলানযুক্ত জানালা, টালি বসানো ঢালু ছাদ, স্তম্ভযুক্ত ‘ওয়াকওয়ে’, ছাদের সম্প্রসারিত অংশ ধরে রাখার সুদৃশ্য ব্র্যাকেট, দীর্ঘ ‘স্পায়ার’-এর মাথায় বহুকৌণিক তারা। সামনে ছিল ফোয়ারা-সমেত সাহেবি বাগান, কেনাকাটার মাঝে জিরোনোর জন্য বেঞ্চ।
পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে বাজার স্থাপনের মূল উদ্যোগী স্যর স্টুয়ার্ট হগ-এর নামে বাজারের নাম রাখা হয় ১৯০৩ সালে। পরবর্তী সময়ে কয়েক ধাপে সম্প্রসারিত হয় বাজার। দোকানের সংখ্যা বাড়ে, পণ্যসম্ভারও। ক্লক টাওয়ারটি যোগ হয় ১৯৩০-এর দশকে। ঘড়ি তৈরির ঐতিহ্যবাহী, ইংল্যান্ডের হাডার্সফিল্ড শহর থেকে আনানো হয় ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ গোত্রের ঘড়ি। জন ব্যারি-র ক্যালকাটা ১৯৪০ বইয়ে আছে সেই সময়ের নিউ মার্কেটের কথা— বাজারের মাঝে অগ্নিনির্বাপক কেন্দ্র, সেখান থেকে চার দিকে সহজে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা রেখে সাজানো দোকানগুলি। ১৮৯৬-এ পুরসভার জন্য মঞ্জুর হওয়া প্রতীক ও নীতিবাক্য বসল স্থাপত্যের গায়ে— শহরের আবর্জনা পরিষ্কারে ভূমিকা মনে রেখে দু’টি হাড়গিলা পাখি, তাদের ঠোঁটে ধরা সাপ, আর ব্রিটিশ রাজমুকুট— কর্তৃত্বের চিহ্ন। সঙ্গে ল্যাটিনে লেখা ‘পের আরডুয়া স্টাবিলিস এস্টো’— ‘সঙ্কটে অবিচল থাকো’।
দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের মতো সঙ্কট পেরিয়েও সগৌরবে বিরাজিত নিউ মার্কেট। একুশ শতকীয় নাগরিক চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মতো মস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এখন খানিক জবুথবু সে। ব্রিটিশ ভারতের একদা-রাজধানী কলকাতার প্রিয় বাজারের সংস্কারের দাবি বহু দিন ধরেই উঠে আসছিল নানা মহল থেকে। সেই কাজে হাত দিয়েছে পুরসভা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় শুরু হয়েছে কলকাতার এই স্থাপত্য-ঐতিহ্যকে সুদীর্ঘ জীবন দানের কাজ।
লজ্জাবতী
রবীন্দ্রনাথের সমকালীন তিনি, কিন্তু অপরিচিত। সংক্ষিপ্ত কবিতাজীবন, অথচ এক কালে বামাবোধিনী, সাহিত্য, প্রদীপ, প্রবাসী, ভারতী পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন লজ্জাবতী বসু (১৮৭৪-১৯৪২) (ছবিতে)। পুত্রবধূ প্রতিমাকে পড়ানোর কাজে একদা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্য রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লজ্জাবতীকে ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বাদুড়বাগান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা লজ্জাবতীর আহ্বানে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন, ১৯২৪-এর আনন্দবাজার পত্রিকা-য় বেরিয়েছিল সে খবর। এত বছর পেরিয়েও অপ্রকাশিত লজ্জাবতী, সে অভাব খানিক মেটালেন সুব্রত রায়চৌধুরী, কবি লজ্জাবতী বসু বইয়ে। ‘তথ্যসূত্র’ প্রকাশিত উনিশ শতক গবেষণা গ্রন্থমালা সিরিজ়-এর দ্বিতীয় এই বইয়ে আছে কবির ৪৩টি কবিতা, জীবনকথা, বংশলতিকা, প্রাসঙ্গিক আলোচনাও। ছবি: বিজয় ভট্টাচার্য
শিক্ষা বৈঠক
করোনাকালে নতুন শিক্ষাপথে ছোটদের যাতে বেশি কষ্ট বইতে না হয়, ক্লাসের সময়ের বাইরেও তাই সচেষ্ট শিক্ষকরা। এ সময়ে তাই আরও জরুরি ‘শিক্ষা বৈঠক’। ২০১৭ থেকে যাত্রা শুরু, কলকাতা জেলা সমগ্র শিক্ষা অভিযানের সভাপতির পরামর্শে, ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর তত্ত্বাবধানে, শিক্ষকেরা একত্র এই সংগঠনে। কলকাতার বাইরে, বেশ ক’টি জেলার স্কুলশিক্ষাকর্মীরাও আছেন সঙ্গে। উদ্দেশ্য: আলোচনা, পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর পদ্ধতির চর্চা। স্কুলের প্রতিটি শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের বয়সোপযোগী বিষয় ভাবা, কর্মপত্র তৈরি ও তা পৌঁছে দেওয়ায় ব্যস্ত এই স্যর-দিদিমণিরা। গত ২৬ জুন ৫০তম ‘শিক্ষা বৈঠক’ হয়ে গেল আন্তর্জালে, ছিলেন দুশোরও বেশি শিক্ষক। ছোট্ট পড়ুয়ারা স্কুলে ফিরবে, ক্লাসরুম-সিলেবাসের সঙ্গে তাদের মানিয়ে নেওয়ার রূপরেখা তৈরি হল সেখানে।
মধু-গান
‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে/ দীন যে, দীনের বন্ধু...’ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে সনেট লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। উনিশ শতকের দুই মনীষার সম্পর্ককথা বাঙালির অজানা নয়, বিদ্যাসাগরের দুশো বছরে সেই সংযোগই ফিরে দেখেছে ‘সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদ’, যার কার্যালয় কৈলাস বোস স্ট্রিটের সেই বাড়ি, বিদ্যাসাগর যেখানে বিধবা বিবাহের সূচনা করেছিলেন। মধুকবির লেখা চতুর্দশপদীতে সুর দিয়ে তাকে গান করে তুলেছেন শিল্পী অলক রায়চৌধুরী, গেয়েছেন শহরের পাঁচটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের শতাধিক ছাত্রছাত্রী, ভিডিয়ো-দৃশ্যায়নও হয়েছে এ গানের। ২৯ জুন ছিল মাইকেলের প্রয়াণদিন, সেই উপলক্ষে পরিষদের ফেসবুক পেজে শোনা যাচ্ছে এ গান।
স্মরণে
অমলেশ ত্রিপাঠীর জন্মশতবর্ষ এ বছর, ‘সোসাইটি ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং কালচার অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া’ (শুচি) তা পালন করল স্মারক বক্তৃতায়, আন্তর্জালে। বক্তা অমলেশবাবুর ছাত্র, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য রজতকান্ত রায় বললেন ‘কাদম্বরীর আত্মহত্যা’ নিয়ে। নিছক আত্মহননের ঘটনা নয়, এর সূত্রে কী ভাবে আবেগের ইতিহাসের বিশ্লেষণ সম্ভব, জানা গেল তা-ও। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রচিত তথাকথিত মুখরোচক সাহিত্য-বয়ান ইতিহাস চর্চার ধারাকে নষ্ট করছে, মত বক্তার। শমিতা সেনের কথায় উঠে এল ঠাকুরবাড়ির বধূদের জীবন, অমলেশ ত্রিপাঠীর স্মৃতিচারণ করলেন অধ্যাপিকা উমা দাশগুপ্ত। শুচি-র ইউটিউব চ্যানেলে আছে অনুষ্ঠানটি।
বই-বিশ্ব
তাঁর বইয়ের বিপুল ভান্ডার যাতে সর্ব স্তরের পাঠকের ব্যবহার্য হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য এক স্বতন্ত্র গ্রন্থাগারের ভাবনা জানালেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, গত ১৭ জুন তাঁর ৮১ বছরের জন্মদিনে, অঞ্জন দত্তকে। বই কী ভাবে হয়ে উঠতে পারে দীর্ঘ সময়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, তারই নিদর্শন এই গ্রন্থাগার। কোনওটির মার্জিনে বিশ্লেষণী টীকা, কোনওটিতে লেখকের স্বাক্ষর বা আঁকা ছবি। পিটার ব্রুকের দি এম্পটি স্পেস, জাঁ-ক্লদ কারিয়ের-এর মহাভারত-চিত্রনাট্য, বাদল সরকারের পাণ্ডুলিপি, মহাশ্বেতা দেবী ও শোভা সেনের চিঠির ঝাঁপিও থাকবে বইয়ের পাশাপাশি। গ্রন্থাদির একাংশ তাঁর বাবা, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক সুনীতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের, যাঁর দুর্লভ সংগ্রহে আছে প্রবাসী-তে প্রকাশিত রক্তকরবী। থাকবে বই নিয়ে শমীকের স্বরভাষ্যও। এই সমস্ত-সহ ক্যাটালগিংয়ের ভারও তিনি দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বই বৈভব ফাউন্ডেশন’কে।
বঙ্গরঙ্গমঞ্চ
সেই যে ২৫ নং ডোমতলায় (এখনকার এজরা স্ট্রিট) বেঙ্গলি থিয়েটার-এর পত্তন করেছিলেন গেরাসিম লেবেদেভ, তৈরি হয়েছিল শতাধিক দর্শকাসনের নাট্যগৃহ, বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সেই অভিযাত্রার বয়স হল ২২৫ বছর। তার বিশাল ব্যাপ্তিকে পত্রিকার দু’মলাটে বাঁধা মস্ত কাজ, তবু বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিচিত্র বিন্যাসকে পঁচিশটিরও বেশি লেখায় ধরার প্রয়াস করেছে কলকাতা পুরশ্রী-র ২২৫ বর্ষে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ সংখ্যা। লিখেছেন বিভাস চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, গৌতম ঘোষ, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ভবেশ দাশ, সৌমিত্র বসু, দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বদের ছবি এঁকেছেন ইন্দ্রপ্রমিত রায়। বাংলা থিয়েটারে মহাভারত, মঞ্চগানে শ্রমজীবন, কলকাতার পেশাদারি ও হিন্দি থিয়েটার, মহিলা নির্দেশকদের কৃতি, নাট্যপত্রের ঐতিহ্য ও পরম্পরা, নাট্যবস্তু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, গিরিশ-শিশিরকুমার-শম্ভু মিত্র-অজিতেশ থেকে ঋত্বিক ঘটকের নাট্যভুবন— বিষয় বহুবিধ। ছবিতে আশির দশকে গালিলেওর জীবন নাটকে বিভাস চক্রবর্তী, শাঁওলী মিত্র ও শম্ভু মিত্র।
মহাজীবন
বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, উনিশ শতকে উপমহাদেশে বৌদ্ধ দর্শন চর্চা ও প্রসারের অগ্রপথিক তিনি। চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র, ১৮৯২ সালে কলকাতায় বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি— বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে যে সংগঠনের শাখা বিস্তৃত হয় দার্জিলিং, জামশেদপুর, রাঁচি, শিলং, লখনউ থেকে সিমলাতেও। ১৯১৫ সালে ধর্মাঙ্কুর সভায় কৃপাশরণ মহাস্থবিরের (১৮৬৫-১৯২৬) মর্মরমূর্তি (ছবিতে) প্রতিষ্ঠা-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, অনাগারিক ধর্মপালের মতো বিদগ্ধজন। সভার মুখপত্র জগজ্জ্যোতি-রও প্রবর্তক তিনি; গ্রন্থাগার, অবৈতনিক প্রাথমিক ও নৈশ বিদ্যালয়, ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা, পালি চর্চা, নারীশিক্ষা প্রসারেও ছিলেন কর্মিষ্ঠ। ছ’বছর আগেই তাঁর জন্মসার্ধশতবর্ষ পেরিয়েছে, কর্মযোগী এই মনীষীর জীবনকৃতি নিয়ে চর্চা অব্যাহত আজও। ২২ জুন তাঁর জন্মদিনে এক আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে তাঁর প্রজ্ঞা ও কীর্তিকে স্মরণ করলেন শঙ্কর কুমার নাথ ও হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী। পুরো জুন মাসটিই ‘কৃপাশরণ মাস’ হিসেবে পালন করেছে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা, তাদের মহতী উদ্যোগে এ শহরও ছুঁতে পারল এক মহাজীবনকে।
টিকার জালে
জুতা আবিষ্কারের না হোক, জাল টিকা আবিষ্কােরর কৃতিত্ব বাঙালিকে দিতেই হবে। আবিষ্কারের গুঁতোটি নিয্যস গণতান্ত্রিক— সাংসদ-অভিনেত্রী, প্রশাসনিক কর্তা থেকে ঘরের লোক মায় প্রিয়তমা, ভেদবিভেদ করেনি। রাত জেগে, অ্যাপ তোলপাড় করে যে তরলাবতার শরীরে ঢুকল, সে কি তবে হামের টিকা? পাউডার-গোলা জল? বাঙালি তবু ক্ষমাশীল এবং সুরসিক এক জাতি, টিকাকারকে নিয়ে ফেসবুক-টুইটারে সুভাষিত পাদটীকা বিলিয়ে যাচ্ছে: টিকা মাটি, মাটি টিকা।