কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
তিনি বাম-মনস্ক। তিনি মনেপ্রাণে বামপন্থীও বটে। সিপিএমের শ্রমজীবী ক্যান্টিনে তাঁর উপস্থিতি নিয়মিত। এ বার বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশের জন্য স্লোগান লিখলেন পেশায় চিকিৎসক এবং নেশায় চলচ্চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ। সেই সমাবেশ সফল করার ডাক দিয়ে একটি স্লোগান তৈরি করেছেন কমলেশ্বর। সম্প্রতি তিনি সেটি নেটমাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টে ‘শেয়ার’ করেছেন। দ্রুত বাম কর্মী-সমর্থকরা তা ‘ভাইরাল’ করে দিয়েছেন।
কমলেশ্বর নিজেকে বরাবর সিপিএমের সমর্থক হিসাবে পরিচয় দেন। আর বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ আগাগোড়া তাঁর কাছে ‘নস্ট্যালজিক’ বিষয়। কারণ, ১৯৭৭ সালে বামেরা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার বছরে প্রথম বাবা সমরেশ্বরের হাত ধরে ব্রিগেড সমাবেশে গিয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকে সবসময় না হলেও কলকাতায় থাকলেই ব্রিগেডে গিয়েছেন একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে। কিন্তু ব্রিগেড সমাবেশের জন্যই নিজ উদ্যোগে স্লোগান লেখা এই প্রথম। ফলে সে অর্থে বামপন্থী হিসাবে সক্রিয় যোগদানের মাধ্যমে এই প্রথম মেঘের আড়াল সরিয়ে বেরোলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরিচালক।
বলছেন বটে স্লোগান। কিন্তু আদতে সেটি একটি গান। যা প্রবাহিত হয়েছে ১০টি লাইনে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে কমলেশ্বর বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয়, এ বারের ব্রিগেড সমাবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই মুহূর্তে দেশ ও রাজ্য যে ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে একজন শিল্পী হিসেবে আমার প্রতিক্রয়া এভাবেই দিতে পারি। আমার মনে হয়, প্রতিক্রিয়া জানানোর এটাই যথার্থ সময়।’’ কমলেশ্বরের স্লোগানে কোনও রাজনৈতিক দলের নামোল্লেখ না থাকলেও নিশানায় রয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূল। এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে কমলেশ্বর বলেছেন, ‘‘দেশ ও রাজ্যে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেই বিষয়গুলির কথা উল্লেখ করেই স্লোগানটি তৈরি করেছি। মূলত তাদের বিরুদ্ধেই কথা বলতে চেয়েছি।’’
এক সময় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সমর্থনে ভর করে দেশের বামপন্থী আন্দোলনের পালে হাওয়া লেগেছিল। নিজেদের গণ আন্দোলনের সঙ্গে সমাজের বিদ্বজ্জনেদের সমর্থন নিয়ে বেশ কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতাদখলও করেছিল বামেরা। তখন উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটকদের সাংস্কৃতিক জগত মারফৎ বামপন্থী প্রচারও উঠেছিল চরমে। কিন্তু ২০২১ সালে দেশজ রাজনীতিতে বামেরা এখন নিতান্তই প্রান্তিক শক্তি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ক্ষমতাচ্যূত হয়ে রাজ্যে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি বামেরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায়। এমতাবস্থায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অনীক দত্তের মতো পরিচালকদের প্রকাশ্য সমর্থন সিপিএম তথা রাজ্যের বামপন্থীদের কাছে বাড়তি অক্সিজেনও বটে।
কমলেশ্বরের ওই স্লোগান যে ব্রিগেডমুখী ‘কমরেড’-দের বাড়তি উৎসাহ যোগাবে, তা এক বাক্যে মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা সুজন চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘একজন সচেতন মানুষ, যাঁর বাংলা প্রসঙ্গে বোধ আছে, মানুষের বিপন্নতা দেখে যিনি ব্যথিত হন, তাঁরা বামপন্থাকেই আকড়ে ধরবেন। ফলে এটাই স্বাভাবিক যে কমলেশ্বরের মতো মানুষরা তাঁদের মতামত জানাবেন। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ, যাঁরা প্রগতির স্বপ্ন দেখেছেন তাঁরা এখনকার পারিপার্শ্বিকতায় বিপন্নতা দেখে প্রতিবাদী হবেন। সেই প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক ধারাতেই এগোবে। কারণ, সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে বামপন্থার কোনও বিকল্প নেই। তাই কমলেশ্বরের তৈরি স্লোগানে বামপন্থা দিয়েই সাধারণ মানুষের কণ্ঠ গর্জে উঠবে।’’
ঘটনাচক্রে, যে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই করেই মূলত পশ্চিমবঙ্গে বামশক্তির উত্থান, এ বারের ব্রিগেড সমাবেশে সেই কংগ্রেসই তাদের অন্যতম সহযোগীর ভুমিকায়। এ ক্ষেত্রে কি দর্শনগত ভাবে ধাক্কা খেয়েছেন কমলেশ্বর? ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরিচালকের জবাব, ‘‘কমিউনিস্ট পার্টিতে মূলত দু’টি পদ্ধতি আছে। প্রথমটি রণনীতি ও অপরটি রণকৌশল। পৃথিবীর রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টিরা নানা সময়ে নানা জোট রাজনীতির মধ্যে গিয়েছে। কখনও কখনও বিষয়ভিত্তিক জোটেও গিয়েছে তাঁরা। এর অর্থ এই নয় যে, পার্টির কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে দর্শনগত বিরোধ শুরু হয়েছে। বিষয়টা তা নয়। তাই এ ক্ষেত্রে আমার কোনও অসুবিধা নেই। এই বিষয়টিকে আমি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছি।’’