অলিম্পিক্সের আসরে বিচারকের পোশাকে ইন্দ্রনীল দত্ত। নিজস্ব চিত্র।
অলিম্পিক পদককে পাখির চোখ করে যখন মনঃসংযোগ করছেন ভারতের দীপিকা কুমারী, ভজন কৌর, তখন ওই একই স্টেডিয়ামে লক্ষ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি ছিল এক বঙ্গসন্তানেরও। তবে প্রতিযোগিতার ময়দানে নয়, তিনি ছিলেন নেপথ্যে। অলিম্পিক্সে তীরন্দাজি প্রতিযোগিতায় ১৪ জনের বিচারক-দলের প্রধান হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করছেন কলকাতার ইন্দ্রনীল দত্ত। তবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ময়দানে তাঁর উপস্থিতি এই প্রথম নয়। টোকিয়ো অলিম্পিক্সেও ইন্দ্রনীল ছিলেন বিচারক হিসেবে।
শনিবার মেয়েদের ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা চলাকালীন, মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে প্যারিস থেকে ফোনে ইন্দ্রনীল জানালেন, ২০০৮ থেকে রেফারি হিসেবে প্রতিযোগিতায় যাচ্ছেন তিনি। ভারত, এশিয়ার নানা প্রতিযোগিতায় কাজ করার পরে আন্তর্জাতিক স্তরে সুযোগ পান। চার-পাঁচ বছর পরে আবেদন করেন বিচারক হওয়ার জন্য। ২০১৫-এ ওয়ার্ল্ড আর্চারি জাজ কমিটিতে যুক্ত হন তিনি। এমবিএ পড়তে যাওয়ার জন্য রিয়ো অলিম্পিক্সে থাকতে না পারলেও টোকিয়োয় ইন্দ্রনীল ছিলেন লাইন জাজ। গত বছর ওয়ার্ল্ড আর্চারি জাজ কমিটির প্রধান (চেয়ারপার্সন) নির্বাচিত হওয়ার পরেই পাঠভবন ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই প্রাক্তনী জানতেন, প্যারিসেও উপস্থিত থাকবেন তিনি।
বক্সিং, ক্যানোয়িং, জুডোর মতো খেলায় বিচারকের আসনে ভারতীয়দের উপস্থিতি থাকলেও তীরন্দাজিতে একমাত্র ভারতীয় ইন্দ্রনীলই। তিনি বলেন, ‘‘যত দূর জানি, অলিম্পিক্সে আগে ভারত থেকে কেউ জাজ কমিটির চেয়ার হিসেবে নির্বাচিত হননি। তবে বিচারক হিসেবে ২০০০-এ সিডনিতে আমার বাবা রথীন দত্ত ও ২০১২-এ লন্ডনে ছিলেন মেঘালয়ের মাতসিওডোর ওয়র।’’
কী ভাবে তীরন্দাজির বিচারক হলেন ইন্দ্রনীল? তিনি জানাচ্ছেন, জাতীয় স্তরের তীরন্দাজ ছিলেন। জিতেছেন একাধিক পদকও। তবে একটা সময়ে বুঝতে পারেন, চাকরি সামলে সে দিকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না। ‘‘ভালবাসার খেলাটার সঙ্গে একটা যোগসূত্র থেকে যাক, সেটা চেয়েছিলাম। তাই ২০০৮-এ তাইপেই গিয়ে রেফারি হওয়ার পরীক্ষা দিই।’’— বলেন ইন্দ্রনীল।
পর পর দু’টি অলিম্পিক্সের অভিজ্ঞতা কেমন? প্যারিসের সঙ্গে টোকিয়োর তুলনা করতে নারাজ ইন্দ্রনীল। বললেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতিতে, ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলা নিয়ে উত্তেজনার আঁচটা একদমই বোঝা যায়নি। সুরক্ষা-বাব্লের মধ্যে থাকতে হত। কোনও রকম ঘোরাফেরার সুযোগ ছিল না।’’ আর এ বার স্টেডিয়াম ভর্তি উৎসাহী দর্শকেরা পুরো পরিবেশই পাল্টে দিয়েছেন জানিয়ে ইন্দ্রনীল বলেন, ‘‘খেলার উপরে দর্শকদের প্রভাবটা এ বার বুঝতে পারছি। একটা আসনও ফাঁকা নেই স্টেডিয়ামে। বিশেষত, ফ্রান্স আর দক্ষিণ কোরিয়ার দর্শকেরা মাতিয়ে রাখছেন তীরন্দাজির ইভেন্টগুলো।’’
ক্রীড়াবিদেরা যেমন দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ নিয়ে মাঠে নামেন, একই রকম চাপে কি তাঁরাও থাকেন? ‘‘অসম্ভব দায়িত্বের একটা কাজ করতে হয় আমাদের। চেয়ার হিসেবে রেফারি-বিচারকেরা ঠিক কাজ করছেন কিনা, সব নিয়ম, কোড অব কন্ডাক্ট মানা হচ্ছে কিনা— সে সব দেখার দায়িত্ব আমার। এ ছাড়া কোনও টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে সেটাও দেখতে হয়। একটা সিদ্ধান্ত কোনও খেলোয়াড়ের কেরিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আমরা প্রচারের আলোয় না এলেও ভুল করার কোনও জায়গা নেই এখানে।’’ আর তাই নিজের দেশের খেলোয়াড়দের নিয়েও আবেগতাড়িত না হতে চেষ্টা করেন ইন্দ্রনীল। শনিবারই যেমন কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার ম্যাচ টাই হয় ভজন কৌরের। ইন্দ্রনীল বলেন, ‘‘হলুদ বৃত্তের মধ্যে মারতে পারলে ভজন জিতে যাবেন, সেটাই মনে হচ্ছিল। তবে ওটুকুই। অবশ্যই চাই যে, দেশে আরও পদক আসুক। কিন্তু অলিম্পিক্সের মঞ্চে আবেগহীন, নিরপেক্ষ থাকাটাই আমাদের কাজ।’’
রবিবার পুরুষদের ব্যক্তিগত ইভেন্ট দিয়ে শেষ হল তীরন্দাজির সব ইভেন্ট। চেয়ারপার্সন হিসেবে নানা অভিজ্ঞতার শরিক হলেও সন্তোষপুরের বাসিন্দা, বছর সাঁইত্রিশের ইন্দ্রনীল ফিরবেন একটা আক্ষেপ নিয়েই। প্যারিস মানেই রোলাঁ গারোজ়ের লাল সুরকির কোর্ট। সেখানে রাফায়েল নাদাল বনাম নোভাক জোকোভিচ আর কার্লোস আলকারাসকে দেখার ইচ্ছেটা রয়ে গিয়েছে ইচ্ছে হিসেবেই।