স্মারক: গার্ডেনরিচে রয়েছে এ দেশের প্রথম ব্যারাজ বেলুনের স্মৃতিফলক। নিজস্ব চিত্র
১৯৪২। তখন এ শহরে সন্ধ্যা নামত কার্ফু আর ব্ল্যাক আউটে।
বিশ্বযুদ্ধের আবহে সে সময়ে রেড রোডে অহরহ দেখা যেত রয়্যাল এয়ারফোর্সের যুদ্ধ বিমানের ওঠানামা। জাপ বোমারু বিমানের আক্রমণ ঠেকাতে এ শহরে তখন রয়্যাল এয়ারফোর্সের বেলুন বাহিনী ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিল। ৯৭৮ নম্বর বেলুন স্কোয়াড্রনের উদ্যোগে কলকাতার গার্ডেনরিচে দেশের প্রথম ব্যারাজ বেলুন উড়েছিল ১৯৪২ সালের ২ জুন। আধুনিক যুদ্ধের কৌশলে পরিবর্তন আসায় পরে বেলুন বাহিনীর গুরুত্ব কমে যায়। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা এবং দেশভাগ পেরিয়ে আসা শহরও ভুলেছে সেই বাহিনীর কথা।
তৎকালীন বিএনআর-এর (বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে) দফতরের কাছেই ঘাঁটি গেড়েছিল রবার্ট ওয়ালিস বেরেসফোর্ডের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। ব্যারাজ বেলুনে গ্যাস ভরতে হুগলি নদীর ধারেই বসানো হয়েছিল বিশেষ হাইড্রোজেন জেনারেটর। কয়েকশো ফুট উঁচুতে উড়তে থাকা ইস্পাতের তারের জাল দিয়ে ঘেরা হাইড্রোজেন ভর্তি অতিকায় বেলুন তখন ব্যবহার করা হত শত্রু শিবিরের বোমারু বিমানের আক্রমণ ঠেকাতে। খুব নিচু দিয়ে উড়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে আঘাত হানতে চাওয়া বোমারু বিমানকে আটকানোই ছিল এই বেলুনের কাজ।
শত্রু শিবিরের যুদ্ধ বিমানের চালকদের কাছে আকাশে এলোমেলো ভাবে ভাসতে থাকা ব্যারাজ বেলুন ছিল কার্যত আতঙ্কের। বিমানের ককপিট থেকে উড়ন্ত বেলুন চোখে পড়লেও মাটি থেকে তাকে আঁকড়ে থাকা অজস্র ইস্পাতের তার দেখা যেত না। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় আগে ভাগেই ওই পথ এড়িয়ে চলতে চাইতেন বোমারু বিমানের চালকেরা।
গার্ডেনরিচ সংলগ্ন খিদিরপুর ডক ছাড়াও হাওড়া ব্রিজ, ফোর্ট উইলিয়াম এবং এসপ্লানেডের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বোমারু বিমানের হানা ঠেকাতে ব্যবহার করা হত ওই বেলুন। লন্ডন শহরকে রক্ষা করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্যবহার হয়েছিল ওই বেলুন। এ শহরে বেলুন বাহিনীর এসে পড়া নিছকই ঘটনাচক্রে। শুরুতে সিঙ্গাপুর বন্দর রক্ষার জন্য ওই বাহিনীকে পাঠানোর কথা ভাবা হলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে আর পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। ইংল্যান্ডের লিভারপুল থেকে সিলন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) পৌঁছনোর পথে সমুদ্রে বাহিনীর দরকারি জিনিস-সহ জাহাজ ডুবে যায়। ইতিমধ্যে জাপান বর্মা (বর্তমান মায়ানমার) আক্রমণ করায় ফের উপকরণ সংগ্রহ করে ওই বাহিনীকে রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গন) পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কলকাতা হয়ে সেখানে পৌঁছনোর আগেই রেঙ্গুনের পতন ঘটায় বেলুন বাহিনী কলকাতাতেই থেকে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লন্ডন শহরকে রক্ষা করতে ওড়ানো হত এই বেলুন। নিজস্ব চিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মাঝ পর্যায়ে। মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তির লড়াইতে জড়িয়ে পড়েছে ঔপনিবেশিক ভারতও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের হানাদারি ঠেকাতে চিনকে তাদের অস্ত্র এবং রসদ দিয়ে সাহায্য করছে ইংরেজরা। সেই রসদ পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম তখন কলকাতা বন্দর। এখান থেকে রেল এবং সড়ক পথে রসদ পৌঁছত অসম হয়ে চিন সীমান্তে।
কলকাতায় ব্রিটিশ বাহিনীর উপরে চাপ বাড়াতে চট্টগ্রাম আক্রমণ করে জাপান বাহিনী। কলকাতা থেকে বিমানবাহিনীর একাংশকে পাঠানো হয় সেখানে। ওই অবস্থায় মাত্র তিন স্কোয়াড্রন বিমান আর বেলুন বাহিনীর উপরে ভার পড়ে কলকাতাকে রক্ষার। চিনে রসদ সরবরাহ আটকাতে ১৯৪২-এর ডিসেম্বরে জাপানের বোমারু বিমান কলকাতা আক্রমণ করে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের আক্রমণে কলকাতার যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় খিদিরপুর ডকও। গার্ডেনরিচে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বাগানে বসানো এক চিলতে ফলক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের এ শহরে বেলুন বাহিনীর একমাত্র স্মারক। যুদ্ধ শেষের পরপর বাহিনীকেও নিয়ে যাওয়া হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোয বলেন, ‘‘ঔপনিবেশিক ভারতের অনেক ইতিহাসই জড়িয়ে আছে দক্ষিণ–পূর্ব রেলের সঙ্গে। বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের সদর দফতরের খুব কাছেই খিদিরপুর ডক। বন্দর বাঁচাতেই সে সময়ে ওই বাহিনী ঘাঁটি গেড়েছিল এখানে। সেই ইতিহাসের স্মারক হিসেবেই ওই ফলক রয়েছে গার্ডেনরিচে।’’