১৮৯৫ সালে সমকামিতায় দণ্ডিত হন অস্কার ওয়াইল্ড। এখন সমকামিতা অপরাধ নয়। তবু ভ্যালেনটাইন্স ডে-র আবহে সংশয়, অস্কারের সময়ের সঙ্গে সমসময় একই রেখায় দাঁড়িয়ে নেই তো?
Third gender

তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে সময় লাগল ৬৪ বছর?

তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে স্বাধীনতার পরে ৬৪ বছর সময় লেগেছে ভারত সরকারের!

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৩৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

১৮৯৫ সালের এপ্রিল মাসে অস্কার ওয়াইল্ডের শুনানি শুরু হয়। সমকামী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হলেন অস্কার। রায় ঘোষণা করে বিচারক বলছিলেন, ‘‘আমার জীবনের সব থেকে খারাপ মামলা।’’ আর ভরা আদালতে ধিক্কার উঠেছিল, ‘লজ্জা, লজ্জা!’ বোসির প্রতি তাঁর অনুরাগ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অস্কার বলেছিলেন, ‘‘এ সম্পর্ক অমলিন স্নেহের সম্পর্ক। এর মধ্যে কোথাও কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই।’’ কিন্তু তাঁর কোনও যুক্তিই শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরীয় যুগের আইনের বর্ম ভেদ করতে পারেনি। অবশ্য তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

Advertisement

যেমন এটাও আশ্চর্যের নয়, তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে স্বাধীনতার পরে ৬৪ বছর সময় লেগেছে ভারত সরকারের! ২০১১ সালে ‘দ্য রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া’ (আরজিআই) পুরুষ (কোড-১) ও নারীর (কোড-২) পাশাপাশি প্রথম বার তৃতীয় লিঙ্গকে (কোড-থ্রি: আদার) জনগণনায় স্বীকৃতি দিয়েছিল। যদিও এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডার) জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যে বিস্তর অসঙ্গতি রয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে। যেমন ‘ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’-এর সঙ্কলিত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, দেশে সমকামী জনসংখ্যা (গে পপুলেশন) হল ২৫ লক্ষ। আবার ২০১৯ সালে লোকসভা অধিবেশনে পেশ করা একটি রিপোর্টের প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের এক কর্তা বলছেন, ‘‘২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশে তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যা ৪,৮৭,৮০৩।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় লিঙ্গের দাবিতে সরব এক সমাজকর্মী বলেন, ‘‘আসলে তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যা সম্পর্কে কারওরই স্পষ্ট ধারণা নেই।’’

আর তাই কি তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বকে মান্যতা দিতে ৬৪ বছর লাগল?

Advertisement

মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের কথায়, ‘‘বি আর অম্বেডকর একটা কথা বলেছিলেন, সংবিধান তৈরি হলেও নানা স্তরে যে অসাংবিধানিক মনোভাব বিদ্যমান, তার কী হবে? এ ক্ষেত্রেও সেই কথাটিই খাটে। অসাংবিধানিক মনোভাবই তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতিদানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’

অস্কারকে কয়েদখানায় পাঠানোর নেপথ্যেও ছিল সেই ‘অসাংবিধানিক মনোভাব’-ই। না হলে কখনও কেউ ভাবতে পেরেছিলেন, ব্রিটেনের প্রতিষ্ঠিত পরিবারে জন্ম, নিজে মেধাবী ছাত্র, অক্সফোর্ডে পড়াশোনা, প্রেম বিবাহ, সুন্দরী স্ত্রী, দুই সন্তানের বাবা অস্কারকে কোনও দিন জেলে থাকতে হবে! এখন নারীর প্রতি যদি কোনও টান অনুভব না করেন তিনি, তার জন্য কী করা যায়! জেলে বসেই অস্কার জানতে পারেন, ‘ওয়াইল্ড’ পদবি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছেন স্ত্রী কনস্ট্যান্স। ‘হল্যান্ড’ পদবি গ্রহণ করেছেন। জানতে পেরেছেন মায়ের মৃত্যু সংবাদও। নিজের ভিতরের ক্ষোভ, যন্ত্রণা, হতাশা বার করতে লিখতে শুরু করেছিলেন অস্কার— ‘প্রিয় বোসি, দীর্ঘ, ব্যর্থ প্রতীক্ষার পরে তোমাকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, আমি এটা মনে করতে চাই না যে, দু’বছর কারাবাসের মধ্যে তুমি এক বারও আমার উদ্দেশে একটা লাইনও লিখলে না!’

কিন্তু সত্যিই কি বোসি বিপদের মধ্যে অস্কারকে রেখে পালিয়েছিলেন? অস্কার ভুলে গেলেন, তিনিই বোসিকে দেশ থেকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। না হলে বোসিরও তো একই শাস্তি হবে। কারণ, সমকাম যে মহাপাপ! যার আত্মীকরণ ঘটেনি বর্তমান সমাজেও। এর কারণ ব্যাখ্যা করে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর ‘ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ বিভাগের অধ্যাপক অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কোনও ছেলে-মেয়ে যদি নিজেদের সমকামী বলেন, তা হলে বেশির ভাগ পরিবারের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারের সামাজিক নির্ভরতা অনেক বেশি।’’ ফলে অস্কারের সময়ে সমকামকে যে রক্তচক্ষুতে দেখা হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!

ফলে অস্কার এটাও জানতে পারলেন না, তাঁর বন্ধুরা যখন বোসিকে লেখা তাঁর সমস্ত চিঠি ফেরত চাইতে গিয়েছিলেন, তখন বিমর্ষ বোসি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যদি অস্কার বলে নিজেকে মেরে ফেলতে, আমি সেটাই করব। আমার মৃত্যুর পর নয় অস্কার এই চিঠিগুলো ফেরত পাবে।’’ বোসির এই উত্তর বন্ধুদের মাধ্যমে কিছুটা বিকৃত, কিছুটা অন্য ভাবে এসে অস্কারের কাছে পৌঁছেছিল। কারণ, বন্ধুরা অস্কার-বোসির সম্পর্কের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তবে অস্কার ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, শুধুই বোসিকে নিয়ে নয়, বরং ব্যক্তিগত ক্ষোভ-দুঃখ থেকে বেরিয়ে আগামী দিনে কী ভাবে তিনি সকলের মুখোমুখি হতে চান, তার সমস্ত চিহ্ন বহন করতে চলেছে এই চিঠি।

‘এটা আমার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। কারণ, এই চিঠিতে আগামী জীবনের প্রতি আমার মনোভাব, কী ভাবে আমি আবার এই পৃথিবীর মুখোমুখি হতে চাই, আমার চরিত্রের পর্বান্তর— সব কিছুই ধরা থাকবে।’ রোবি রস, তাঁর আজীবনের বন্ধুকে অস্কার রাজিও করিয়েছেন, যে ভাবেই হোক এ চিঠি বোসির কাছে পৌঁছতেই হবে। যে ভাবেই হোক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement