—প্রতীকী ছবি।
ছেলেকে ছুটি করিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে অবাক পরিবারের লোকজন। অন্যান্য বিলের সঙ্গেই তাঁদের ধরানো হয়েছে আর একটি বিল। তাতে লেখা, ‘বিড়ির খরচ’ সাড়ে তিন হাজার টাকা! এক জন আবাসিকের জন্যই নাকি বিড়ি বাবদ খরচ পড়েছে সাড়ে তিন হাজার! কোনও হোটেলের তো নয়ই, এটি পাড়ার পান-বিড়ির দোকানের মাসিক বিলও নয়। এক আবাসিকের পরিবারকে এই বিল ধরিয়েছে একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে!
পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে এবং ছেলের আপত্তিতে এর পরে বিষয়টি নিয়ে আর আইনি পথে তাঁরা হাঁটেননি বলেই দাবি করেছেন ওই পরিবারের সদস্যেরা। তবে প্রতিবাদ করায় নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকেই তৎক্ষণাৎ বিলের অঙ্ক কমিয়ে দেওয়া হয় বলে তাঁদের দাবি। ৫০০ টাকায় রফা হয়ে গেলেও এই ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, কোনও নেশামুক্তি কেন্দ্র কী করে নেশার সামগ্রীর খরচ চায়? কী করেই বা কোনও নেশামুক্তি কেন্দ্রে কাউকে নেশার সামগ্রী দেওয়া হয়? আইনি দিক থেকেই বা বিষয়টি কতটা বৈধ? আইনজীবী থেকে চিকিৎসকদের বড় অংশই বলছেন, ‘‘এমনটা হওয়ার কথা নয়। পুরোটাই বেআইনি। নেশামুক্তি কেন্দ্রেই নেশা করার সুযোগ থাকলে তো এমন কেন্দ্র চালানোর উদ্দেশ্যটাই ধাক্কা খায়।’’ মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘এমন কিছু ঘটে থাকলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবারের লোকজনেরই এগিয়ে এসে অভিযোগ জানানো উচিত।’’ যদিও যে নেশামুক্তি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেটির মালিক ছায়া দত্ত বললেন, ‘‘বললেই তো আর নেশা ছাড়ানো যায় না। তাই নেশাগ্রস্তকে বশে রাখতে আমরা বিড়ি দিই। সেই বিড়ির দামটাই চেয়ে নেওয়া হয় পরিবারের থেকে।’’
তবে, কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, শহর সংলগ্ন এলাকায় গজিয়ে ওঠা নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে এ ভাবেই নেশার সুযোগ জিইয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সামনে আসে আরও গুরুতর ব্যাপার। নেশার সামগ্রী অতিরিক্ত নেওয়ার কারণে মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। পরিবারের লোকজনকে জানানো হয়, লুকিয়ে নেশা করছিলেন সংশ্লিষ্ট আবাসিক। বাধা দিতে গিয়েই বিপদ ঘটেছে। নেশামুক্তি কেন্দ্রে দীর্ঘদিন কাটানো কারও কারও অভিযোগ, ব্যথার ওষুধ আর উদ্বেগ কমানোর ওষুধ দেওয়া হয় একসঙ্গে মিশিয়ে। কখনও আবার অত্যধিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় যে কোনও একটি। বাদ যায় না নেশা ছাড়ানোর ওষুধও। অভিযোগ, পাইকারি বাজার থেকে নির্দিষ্ট গুদামঘর ঘুরে নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মীদের মাধ্যমে ওষুধগুলি পৌঁছে যায় নেশাসক্তদের হাতে। কখনও ট্যাবলেটের আকারে, কখনও আবার ইনজেকশনের ভায়ালে।
দিনকয়েক আগে কলকাতার নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর (এনসিবি) তদন্তকারীরা এমনই এক চক্রের হদিস পান বড়বাজারে। সেখানকার পাইকারি বাজারের এমন একাধিক ওষুধ হাত বদলে চলে যাচ্ছিল তিলজলার একটি গুদামে। সেখান থেকেই তা খুচরো সামগ্রী হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছিল। একটি সূত্রে খবর পেয়ে সেখানে হানা দেন এনসিবি-র আধিকারিকেরা। গ্রেফতার করা হয় চার জনকে। তদন্তে জানা যায়, বড়বাজারের একটি ওষুধ সংস্থা থেকে প্রচুর পরিমাণ ‘সাইকোট্রপিক’ এবং ‘নার্কোটিক’ ওষুধ বিক্রি করা হয়েছে বিনা কাগজপত্রে। দাম মেটানো হয়েছে নগদ টাকায়। ওই সংস্থারই এক কর্মী ওই সমস্ত ওষুধ কিনে তা পৌঁছে দিতেন তিলজলার গুদামে। সেখান থেকে ওষুধ কিনতে যাঁরা আসতেন, তাঁদের অনেকেই কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মী। ওই মামলার তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘মাদকের থেকে এমন ওষুধ বেশি সহজলভ্য। নেশামুক্তি কেন্দ্রে মাদক নিয়ে যাওয়া কঠিন, কিন্তু ওষুধ একেবারেই নয়।’’
এর পরে কয়েকটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে হানা দেন তদন্তকারীরা। তল্লাশিতে প্রচুর নেশা ছাড়ানোর ওষুধ উদ্ধার হয়। জানা যায়, নেশা ছাড়ানোর নামে ব্যবসা ফেঁদে বসে এমন ওষুধ বিক্রি করেই আবাসিকদের পরিবারের থেকে টাকা হাতাতেন নেশামুক্তি কেন্দ্রের মালিকেরা। কিন্তু এ জিনিস জানাজানি হওয়ার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলে
অভিযোগ। ‘বেঙ্গল কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘যে ১২টি ‘হ্যাবিট ফর্মিং’ ওষুধ রয়েছে, সেগুলির বিক্রি করার ব্যাপারে ওষুধের দোকানের মালিকদের আরও সতর্ক হতে বলছি আমরা। তবে, পুলিশকেও আরও সতর্ক
হতে হবে।’’ যদিও লালবাজারের কর্তারা বলছেন, অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে কেন আগেই পুলিশ তৎপর হয়ে পদক্ষেপ করবে না? এ প্রশ্নের অবশ্য স্পষ্ট উত্তর মিলছে না। (শেষ)