যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত মহম্মদ আরিফের দাদা। —নিজস্ব চিত্র।
বাবা দিনমজুর। সংসার কোনও রকমে চলে। কিন্তু ভাই ‘বুদ্ধিমান’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসে রয়েছে বছর তিনেক হল। ভাইকে নিয়ে তাঁর এবং তাঁর বাবা-মার আশা ভরসাও প্রচুর। তবে সেই ভাই, মহম্মদ আরিফের গ্রেফতারির খবর পেয়ে আকাশ ভেঙে পড়েছে তাঁর মাথায়। পুলিশের ফোন পেয়েই সুদূর জম্মু-কাশ্মীর থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছেন তাঁর দাদা। সঙ্গে এসেছেন এক জেঠতুতো দাদাও। গ্রেফতারি তো দূরের কথা তাঁদের ভাই যে কোনও অপরাধ করতে পারেন, তা-ও বিশ্বাস করতে নারাজ তাঁরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় বুধবারই পুলিশ আরও ছ’জন পড়ুয়াকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা আরিফ। যে আরিফ মৃত পড়ুয়ার পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ফেলেছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছিলেন ছাত্রেরা। কিন্তু হাত ফস্কে যাওয়ায় নাকি ওই পড়ুয়া নীচে পড়ে যান। অসমর্থিত এক সূত্রের দাবি, যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরেই নাকি আরিফকে গ্রেফতারির সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতা পুলিশ। আরিফকে গ্রেফতারির পর তাঁর পরিবারকে ফোন করে পুলিশ। আরিফের বাড়িতে নোটিসও পাঠানো হয়। পুলিশের ফোন পেয়েই কলকাতায় ছুটে এসেছেন আরিফের দুই দাদা। আর কলকাতা পৌঁছেই অথৈ জলে পড়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, ভাই আরিফকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে, তা তাঁরা জানেন না। ভাই আসলে কী করেছে, এই প্রশ্নও ভাবাচ্ছে তাঁদের। তাঁরা জানিয়েছেন, কেন আরিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিয়ে কেউই সদুত্তর দিচ্ছেন না। পুলিশকে গিয়ে এফআইআর কপি চাওয়া হলে তাঁদের তা কোর্ট থেকে নিয়ে আসতে বলা হয় বলেও দাবি করেছেন আরিফের জেঠতুতো দাদা মারুফ।
মারুফের কথায়, ‘‘আরিফ যে গ্রেফতার হয়েছে তা জানতাম না। পুলিশ ফোন করেছিল। একটা নোটিসও পাঠিয়েছিল। তার পরেই কলকাতায় ছুটে আসি। কিন্তু আমরা কিছুই জানতে পারছি না। আরিফকে কোন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তা-ও এখনও জানতে পারিনি। এফআইআর কপি দিতে বলেছিলাম। দেওয়া হয়নি আমাদের। কোর্ট থেকে নিতে বলেছে। আমরা এখন কী করব, বুঝতে পারছি না।’’
অন্য দিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরিফের দাদা বলেন, ‘‘বাবা দিনমজুরি করে। ভাই যে কী করে কিছু করতে পারে, বুঝতে পারছি না। ভাই খুব ভাল ছেলে। খুব বুদ্ধিমান। কেন ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানি না। জানার চেষ্টা করছি। শুধু এটুকু বলতে পারি যে ও কাউকে মারতে পারে না।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া আরিফ গ্রেফতার হয়েছেন পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে। স্থানীয় সূত্রের খবর, যাদবপুরের প্রধান ছাত্রাবাসে আরিফ যেখানে থাকতেন, তার নীচের তলাতেই থাকতে এসেছিলেন মৃত পড়ুয়া। পুলিশের কাছে আরিফ দাবি করেছিলেন, ঘটনার দিন রাতে নীচ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নীচে নামেন তিনি। সেই সময় নাকি মৃত ওই ছাত্র অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন। তিনিও ওই পড়ুয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। আরিফ পুলিশকে এ-ও জানিয়েছিলেন, ওই পড়ুয়া যখন ছাত্রাবাসের বারান্দা থেকে নীচে পড়ে যান, তখন তিনিই তাঁর হাত ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঘর্মাক্ত হাত কোনও ভাবে ফস্কে যায় এবং ওই পড়ুয়া সোজা নীচে এসে পড়েন। তিনি যখন ওই পড়ুয়ার হাত ধরে ফেলেছিলেন, তখন বারান্দার একটি দড়ি তাঁর কপালে ঘষে যায় বলেও পুলিশকে জানিয়েছিলেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, আরিফ-সহ যাদবপুরের ছাত্রেরা বয়ানে দাবি করেছিলেন, চিৎকারের আওয়াজ শুনে উপরের তল থেকে নীচে নেমেছিলেন আরিফ। কিন্তু তদন্তে উঠে এসেছে, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নয়, ঘটনার আগে এবং পরে সেখানেই উপস্থিত ছিলেন আরিফ। পুলিশ জানতে পেরেছে, হস্টেলের তিন তলা থেকে পড়ার সময় যে ১২-১৩ জন আবাসিক এবং পড়ুয়ারা সেই তলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরই অন্যতম আরিফ।
ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় এ নিয়ে মোট ন’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পড়ুয়াদের পাশাপাশি রয়েছেন কয়েক জন প্রাক্তনীও। পুলিশ জানতে পেরেছে, যাদবপুরের প্রধান ছাত্রাবাসে অন্তত ২০ জন ছাত্র এমন থাকেন, যাঁরা আর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই নন।