সন্ধান: বৃহস্পতিবার হেরিটেজ ওয়াকে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র
ইতিহাস নগরীর ঐতিহাসিক তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন পড়ুয়ারা। দমদম, উত্তর দমদম, দক্ষিণ দমদম, রাজারহাট উপনগরী-পঞ্চায়েত এবং কলকাতা পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে ছিল ব্রিটিশ আমলের বৃহত্তর দমদম। সেই শহরের অজানা তথ্য নথিভুক্ত করতে গড়ে উঠেছে ‘দমদম হেরিটেজ সংরক্ষণ সোসাইটি’। বৃহস্পতিবার ছিল ‘হেরিটেজ ওয়াক’। দমদমের যে ইতিহাস অপরিচিত, তার সঙ্গে পরিচয় ঘটল সোসাইটির সদস্য সাতটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের পড়ুয়াদের।
এই দমদম এখনকার মাইক-নগরী নয়। বেদখল ফুটপাথ, ঘিঞ্জি রাস্তা, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ, ইট-সিমেন্ট-বালির বরাতের লড়াই, বন্ধ জেসপ কারখানা এবং বছরভর উৎসব আয়োজনের কথা বলে না। কলকাতা বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকেই যে সিপাহি বিদ্রোহ এক সময়ে উড়ান দিয়েছিল তা জানান দেয়। এইচএমভি কারখানার ভিতরে যে ইতিহাসের উপরে ধুলোর স্তর পড়েছে তা সরিয়ে দেওয়ার কাজ করে। পিপলস গ্রিন সোসাইটি এবং দেশকালের অভিভাবকত্বে যে কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন সরোজিনী নায়ডু মহিলা কলেজ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন, বিধাননগর কলেজ, রাজারহাটের ডিরোজিও, বিরাটির মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপীঠ এবং মতিঝিল কলেজের পড়ুয়ারা।
এ দিন ‘হেরিটেজ ওয়াক’-এর একটি দিনমাহাত্ম্য রয়েছে। গবেষক মৌমিতা সাহা জানান, দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকেই এনফিল্ড রাইফেলে ব্যবহৃত কাগজের টোটা তৈরি হত। আর্দ্রতা ঠেকাতে টোটার খোলে গরু এবং শুয়োরের চর্বি যে মেশানো হয়, সেই খবর দমদম ক্যান্টনমেন্টের সেনাদের কাছে প্রথম পৌঁছয়। ১৮৫৭ সালের ২২ জানুয়ারি ‘বেঙ্গল আর্টিলারি’-র সেনারা প্যারেড করার সময়ে ওই কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন। কলকাতা বিমানবন্দরের রানওয়ে ছিল সেই প্যারেড গ্রাউন্ড। যার প্রেক্ষিতে এ দিন ছাত্রছাত্রীরা যাতে সরেজমিনে ওই ইতিহাস আত্মস্থ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করেন কলকাতা বিমানবন্দরের অধিকর্তা কৌশিক ভট্টাচার্য।
বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে এইচএমভি কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসবিদ শ্যামল ঘোষ সেনাদের হাসপাতাল কী ভাবে গ্রামোফোন কোম্পানিতে রূপান্তরিত হল, তা ছাত্রছাত্রীদের জানান। এইচএমভি কারখানার কাছেই অবস্থিত দমদম ক্যান্টনমেন্টের কবরস্থান। নোয়াপাড়া-বিমানবন্দর মেট্রো প্রকল্প চালু হলে কবরস্থানের মাটি ছুঁয়ে পাতালে প্রবেশ করবে রেল। ক’জনেরই বা জানা মাটি এবং পাতালের সংযোগস্থলের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের সেনাদের সমাধি ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজারো গল্প।
সরোজিনী নায়ডু কলেজের ছাত্রী বহ্নি দাস বলেন, ‘‘রোজ যে পথ ধরে কলেজে যাতায়াত করি তার আশপাশে যে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে তা আগে জানা ছিল না।’’ বিরাটির মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপীঠের ছাত্রী প্রিয়া পাল বলেন, ‘‘এ কাজে যুক্ত হতে পেরে ভাল লাগছে। সম্পূর্ণ অন্য রকম অভিজ্ঞতা।’’ মুসলিম, ব্রিটিশ, এবং আধুনিক যুগের ইটের মধ্যে কী ভাবে তফাৎ করতে হয়? নবরত্ন কেন বলা হয়? চালা কী? যত জানছেন তত অভিভূত হচ্ছেন পড়ুয়ারা।
এ দিন বিমানবন্দরে ইতিহাসের পড়ুয়াদের স্বাগত জানিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরের রিজিওনাল এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর সুরেশ প্রকাশ যাদব বলেন, ‘‘এই ইতিহাসের কথা বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের সামনে কী ভাবে তুলে ধরা যায়, তা নিয়ে কিছু করার কথা আমাদের ভাবনায় রয়েছে।’’
গবেষক মৌমিতা জানান, ঐতিহাসিক নগরী দমদমকে ২১টি জ়োনে ভাগ করে নথি সংগ্রহের কাজ করবেন ছাত্রছাত্রীরা। গবেষকের কথায়, ‘‘আমরা চাইছি, দমদমের ইতিহাস দমদমের মানুষই রচনা করবেন।’’