বেআইনি: গলি দখল করে এমন বিপজ্জনক ভাবে তৈরি হয়েছে সেই বহুতল (চিহ্নিত)। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
কোনও এক সময়ে এটি ছিল দু’টি বাড়ির মাঝের গলিপথ। সাড়ে চার ফুট চওড়া সেই গলি দখল করে উঠে গিয়েছে আস্ত চারতলা বাড়ি! নির্মাণের অনুমতি থাকার কথা নয়। নেই-ও। বাড়ির ভিতরে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করার সামান্য পরিসরও নেই। মিটার ঘর রয়েছে সিঁড়ির নীচে। বাদ যায়নি ছাদও। সেখানেও ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গার্ডেনরিচের বিচালিঘাট রোডে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল এমনই একটি বাড়ি। ঘটনার সময়ে ওই বাড়ির সামনে ইদের কেনাকাটা চলছিল। প্রথমে ধোঁয়া বেরোতে দেখে বাসিন্দাদের অনেকে ভেবেছিলেন, আগুন লেগেছে। সেই মতো তাঁরা ছুটে যান। এরই মধ্যে ঘটে বিস্ফোরণ। ছিটকে বাইরে পড়ে যান অনেকে। কাছেই একটি দোকানের গায়ে লাগানো ম্যানিকুইন উড়ে গিয়ে পড়ে উল্টো দিকের দোকানের চালে। পরে বোঝা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে ঘটেছে ওই বিস্ফোরণ।
ঘটনায় জখম এক কিশোর এবং এক কিশোরী-সহ ২২ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএমে। শুক্রবার ছেড়ে দেওয়া হয় পাঁচ জনকে। বাকি ১৭ জন এখনও পিজিতে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে ট্রমা কেয়ারের রেড জ়োনে ক্রিটিক্যাল কেয়ারে রয়েছেন আব্দুল আজ়িম নামে ৪২ বছরের এক ব্যক্তি। ১২ জন ভর্তি বিপর্যয় মোকাবিলা ওয়ার্ডে। বাকি চার জন বার্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, আব্দুল-সহ পাঁচ জনের সঙ্কট এখনও কাটেনি। তবে তাঁরা স্থিতিশীল রয়েছেন। আহতদের চিকিৎসার জন্য শল্য, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কোথায় এবং কী ভাবে এই আগুন লেগেছিল, তা স্পষ্ট হয়নি ঘটনার এক দিন পরেও। শুক্রবার ঘটনাস্থলে যান ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। লালবাজার সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে তাঁরা জানিয়েছেন, গ্যাস সিলিন্ডার লিক করে আগুন লেগে থাকতে পারে। এর পরে তাপে সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় পুলিশের তরফে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে।
এ দিন সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দু’টি বহুতলের মাঝের গলিপথে গজিয়ে ওঠা ওই বাড়িটির গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। গ্রিলের উপরে লেখা বাড়ির নম্বর— বি-১৭৭/বি। বাইরে চৌকি পেতে বসে ওই বাড়িরই বাসিন্দারা। তাঁদেরই এক জন অমিত সাক্সেনা জানালেন, বাড়ির একতলার ফ্ল্যাটে থাকেন বাড়িওয়ালা। উপরের তিনটি তল এবং ছাদের ঘর মিলিয়ে বসবাস করে আরও চারটি পরিবার। অমিত বলেন, ‘‘পৌনে ছ’টা নাগাদ আগুন লাগে। পরের মুহূর্তে বিকট আওয়াজ শুনি। কিন্তু নীচের ঘরেই যে হেতু আগুন লেগে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে, তাই মূল গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারিনি। কিছু ক্ষণ আটকে থাকার পরে পাশের বাড়ির ছাদ টপকে বেরোতে হয়েছে।’’
ওই চারতলা বাড়িটির পাশে একটি বহুতলে রয়েছে বাজার। সেই বাজারের মাঝের রাস্তা দিয়ে পিছন দিকে গিয়ে দেখা গেল, বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই ছিল যে, ওই গলিপথে তৈরি হওয়া চারতলা বাড়িটির পিছন দিকের দেওয়াল ভেঙে গিয়েছে। সেখান দিয়েই দেখা যাচ্ছে, উপরে ওঠার সরু সিঁড়ি। মিটার বক্স থেকে উড়ে বেরিয়ে আসা মিটারের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে রয়েছে চার দিকে। পাশের বাড়িটির ঠিকানা বি-১৭৭/এ। একটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির মাঝে নির্দিষ্ট অংশ ছাড়ার কোনও বালাই নেই।
বি-১৭৭/বি ঠিকানার বাড়িটিতে ঢুকতে গিয়ে দেখা গেল, বিস্ফোরণস্থলের পাঁচিল হাঁ হয়ে আছে। দেওয়াল ধসে পড়ায় দেখা যাচ্ছে পোড়া এসি এবং অন্য আসবাব। বি-১৭৭/এ বাড়ির একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ফ্ল্যাট দেখিয়ে সেখানকার বাসিন্দা মহম্মদ শাহিদ বললেন, ‘‘গলি দখল করে এ ভাবে বাড়ি হয়েছে। এই বাড়ির মালিকের এখানে একটা অনুষ্ঠান বাড়ি রয়েছে। তিনি প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পান না। দেখবেন, এতগুলো প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরেও কিচ্ছু বদলাবে না!’’