প্রতীকী ছবি।
পায়ে পচন ধরে ঘা হয়ে গিয়েছে। তাতে থিকথিক করছে পোকা। একটা সময়ের পরে চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, পা কেটে বাদ দিতে হবে। না-হলে পুরো শরীরেই সেই পচন ছড়িয়ে যাবে। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, মাদক নিতে নিতে ওই যুবকের পায়ের শিরা নষ্ট হয়ে গিয়েই পচন ধরে গিয়েছিল। হুগলির বাসিন্দা সেই যুবক সৌরভ চক্রবর্তীর একটি পা বাদ দিয়ে নকল পা লাগাতে হয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকার পরে বাড়ি ফিরে দেখলেন, বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়েছে। বাড়িও বেহাত।
বছর তেত্রিশের রঙ্গন মিত্র ট্রেনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আত্মঘাতী হবেন বলে। কিন্তু বেঁচে যান তিনি। শরীরের ১২টি হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অস্ত্রোপচার করে হাতে-পায়ে প্লেট বসাতে হয়েছিল। তবে তত ক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে তাঁর সংসার। স্বামীকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান স্ত্রী।
ঘরবাড়ি, টাকাপয়সা বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। সম্পূর্ণ একা আর নিঃস্ব অবস্থায় হাসপাতালে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছিল রঙ্গনকে। কারণ, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মাদক নিতে নিতে এক সময়ে কেমিক্যাল ইঞ্জেকশন নিতে শুরু করেন ওই যুবক। যার ফলে তাঁর হাত-পা থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন জায়গার শিরা নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু সৌরভ বা রঙ্গন নন। এই শহরে এমন বহু যুবক রয়েছেন, যাঁদের শরীরের একটা দিক পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। কারও আবার দু’টি পা-ই বাদ চলে গিয়েছে। অনেকে আবার মাদক নিতে নিতেই তীব্র অবসাদে আক্রান্ত হয়ে বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। মাদকের নেশায় পেশাদার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে, এমন উদাহরণ তো ভূরি ভূরি। কিন্তু মাদকে আসক্তি তৈরি হয় কী ভাবে?
এক সময়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা রঙ্গন জানালেন, কেউ মাদক নেন শুধুমাত্র নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে। কেউ আবার ব্যক্তিগত জীবনের যন্ত্রণা ভুলে থাকতে নিজেকে নেশায় ডুবিয়ে রাখতে চান। কিন্তু যখন কেউ মাদক নিতে শুরু করেন, তখন বুঝতে পারেন না, এক বার এ পথে পা বাড়ালে ফেরা খুব কঠিন। পরে ফেরার চেষ্টা করতে গেলেই মস্তিষ্ক বিদ্রোহ করে। সে বারবার নেশার জিনিস চায়। তাই মাদকাসক্তেরা অনেকেই নেশা ছাড়তে গিয়েও ছাড়তে পারেন না।
কলকাতার যুবক সুদীপ্ত দত্ত (নাম পরিবর্তিত) নেশা শুরু করেন বিড়ি-সিগারেট দিয়ে। পরে অবশ্য হেরোইন থেকে কোকেন বা এলএসডি— কিছুই বাদ ছিল না। শেষে কেমিক্যাল ইঞ্জেকশন। কিন্তু তাঁর সেই নেশায় শেষ হয়ে গিয়েছে সংসার।
শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের বক্তব্য, ‘‘আমার এক রোগী রয়েছেন, মাদক নিতে নিতে যাঁর সমস্ত শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ছ’বার অস্ত্রোপচার করতে হয়।’’ ওই ব্যক্তির হাত-পা বেঁকে গিয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গড়িয়ার বাঁশপোঁতার এক মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক সঞ্জীব দে-র কথায়, ‘‘যখন কেউ নেশা করেন, তখন তার পরিণতি কী হতে পারে, তা জানলেও ও সব নিয়ে কেউ ভাবেন না। নেশা এমনই এক জিনিস। পরিণতি জেনে ভয় পেলে অনেক ছেলেমেয়ে বেঁচে যেত।’’ কিন্তু এই পরিস্থিতি হতে পারে জেনেও কেন এই ধরনের নেশায় মজেছে এখনকার তরুণ-প্রজন্ম?
মনোরোগের চিকিৎসক প্রথমা চৌধুরীর কথায়, ‘‘মাদকের প্রতি আসক্তি কিন্তু শুধু পরিবেশ-পরিস্থিতির উপরেই নির্ভর করে না। এটা একটা মস্তিষ্কের অসুখ। তাই এক বার আসক্ত হয়ে পড়লে তার পরে আর ছাড়া যায় না। মস্তিষ্কে একটা ‘ট্রিগার’ কাজ করে। মাদক নিতেই হবে বলে মস্তিষ্ক ‘সিগন্যাল’ পাঠায়। তখন মাদক না নিয়ে উপায় থাকে না।’’ প্রথমা অবশ্য আশা দিয়েছেন, ঠিকমতো চিকিৎসা করানো হলে মাদকাসক্তি থেকে বেরোনো অসম্ভব নয়।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।