—প্রতীকী চিত্র।
অ্যাপ-ক্যাবে ওঠার পরেই দেখা যাচ্ছে, চালক খুবই ব্যস্ত এবং উত্তেজিত। তবে এই ব্যস্ততা বা উত্তেজনা গাড়ি চালানো নিয়ে নয়, বরং তিনি ব্যস্ত ফোনে। ‘ট্রিপ’ শুরু করার পরেই লাগাতার তাঁর ফোন আসছে, আর স্টিয়ারিংয়ে বসেই অনবরত ফোনে কথা বলে চলেছেন তিনি। কাউকে হাতে-পায়ে ধরার কায়দায় বলছেন, ‘‘কাল খুব চাহিদা ভাই। নগদ টাকা পেয়ে যাবি, ডিউটি করে দে।’’ কাউকে আবার বলছেন, ‘‘কাল গাড়িটা চালিয়ে দে। প্রতি ঘণ্টায় ২০০ টাকা করে বেশি দেব!’’
কী ব্যাপার? গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে সংশ্লিষ্ট চালককে এ নিয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, ‘‘এ বছরের শেষ রাতে আর নতুন বছরের জন্য গাড়িচালক চেয়ে ফোন আসছে। মারাত্মক চাহিদা। অনেকেই পার্টি করতে যাবেন, নিজে গাড়ি চালাবেন না। হয়তো গাড়ি চালানোর মতো অবস্থাতেও থাকবেন না। তাই চালকের চাহিদা। স্টিয়ারিং ধরে আসনে বসে গাড়ি এগোনো-পিছনো করতে পারে, এমন লোককেও কাল কাজ চালিয়ে দেওয়ার জন্য হাতে-পায়ে ধরতে হচ্ছে!’’
গাড়িচালকের জোগান দেয় এমন সংস্থায় ফোন ঘুরিয়ে দেখা গেল, সত্যিই বর্ষশেষে চালকদের চাহিদা তুঙ্গে। শহরে এমন বহু সংস্থা রয়েছে, যাদের ফোন করতেই বলে দেওয়া হল, ৩১ ডিসেম্বর আর ১ জানুয়ারির জন্য কোনও চালক নেই। সব বুকিং হয়ে গিয়েছে! পরিস্থিতি এমন যে, প্রায় বছরভর গাড়ি বা চালক ভাড়ায় নেন এমন ব্যক্তিদেরও বলে দেওয়া হচ্ছে যে, ওই দু’দিনের জন্য চালক অমিল। সারা বছর যে সংস্থা থেকে চালক ভাড়ায় নিতে পাঁচ ঘণ্টার জন্য ৪৫০ টাকা এবং তার পর থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ টাকা করে দিতে হয় সেখানেও বলা হচ্ছে, প্রথম তিন ঘণ্টার রেট ৫০০ টাকা। এর পরে প্রতি ঘণ্টায় দিতে হবে ২০০ টাকা করে। এমন সংস্থাও রয়েছে, যাঁরা পাঁচ ঘণ্টার জন্য চালক ভাড়ায় দিতে দর হাঁকছেন হাজার টাকা!
খোঁজখবর নিতে জানা গেল, বর্ষশেষ এবং বর্ষবরণ ঘিরে এমন গাড়িচালকের হাহাকার তৈরি
হয়েছিল গত বছরেও। পুলিশের রিপোর্টে উঠে এসেছিল আরও আশঙ্কার খবর। দেখা গিয়েছিল, ৩১ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ ৫৪০ জনকে গ্রেফতার করেছিল। বেপরোয়া ভাবে এবং মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে ১৮৭ এবং ১৭৯টি ক্ষেত্রে। বছরের প্রথম দিনে গ্রেফতার করা হয় ২০৮ জনকে। ওই দিন বেপরোয়া এবং মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় যথাক্রমে ১০৫ এবং ১০১টি ক্ষেত্রে। জানা যায়, সেই ধৃতদের ৭০ শতাংশ কোনও না কোনও গাড়িচালক ভাড়া দেওয়ার সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ মাত্র ১০ দিন আগে লাইসেন্স পেয়েছিলেন। কারও আবার সেটুকুও ছিল না। সপ্তাহখানেক আগে হাতে আসা শিক্ষানবিশ (লার্নার) লাইসেন্স নিয়েও অনেকে স্টিয়ারিংয়ে বসে পড়েন। অনেকে আবার ৩১ ডিসেম্বর রাতভর গাড়ি চালিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন ফের বেরিয়েছেন গাড়িচালক ভাড়া দেওয়া সংস্থার হয়ে! এর পরে ক্লান্ত শরীরে, অপটু হাতে তাঁদেরই কেউ কেউ বেসামাল হয়ে ধাক্কা মেরেছেন বাতিস্তম্ভে, কেউ ট্র্যাফিক সিগন্যাল না বুঝে ঢুকে পড়েছেন একমুখী রাস্তায়। কিছু ক্ষেত্রে আবার পথচারী বা সহযাত্রীদের গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতেও হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে গত বারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তৎপর হয়েছে পুলিশও। লালবাজার সূত্রের খবর, বার এবং রেস্তরাঁ মালিক সংগঠনের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা হয়েছে। সেখানে আসা কেউ বেসামাল হলে নিজের গাড়ি রেখে অ্যাপ-ক্যাবে ফেরত পাঠানোর উপরে জোর দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে নজরদারিতে থাকা সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা বোঝানোর কাজ করবেন বলেও জানানো হচ্ছে। তবু কেউ নিজের গাড়িতেই ফিরতে চাইলে তাঁকে অবশ্যই প্রশিক্ষিত চালকের মাধ্যমে বাড়ি পাঠানোর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স দেখে নিয়ে তবেই কোনও চালক ভাড়ায় নেওয়ার ব্যাপারেও সচেতনতা প্রচার করা হচ্ছে।
‘হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’-র সভাপতি সুদেশ পোদ্দার বলেন, ‘‘বর্ষশেষের রাত এবং নতুন বছরের প্রথম দিনের জন্য বার এবং রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষেরাই বেশ কিছু চালকের সঙ্গে আগাম কথা বলে রেখেছেন। কেউ চাইলে মোবাইল থেকেও অ্যাপনির্ভর চালককে ভাড়া নিতে পারেন। তবে সব ক্ষেত্রেই চালকের লাইসেন্স দেখে নিয়ে এগোনো জরুরি। পুলিশ ও আমাদের সংগঠনের তরফেও সর্বত্র সেটাই প্রচার করা হচ্ছে।’’