n অপেক্ষা: বিআইএনে চিকিৎসার জন্য সুমন দত্তকে নিয়ে এসেছিলেন পরিজনেরা। ছবি: রণজিৎ নন্দী
হাসপাতাল চত্বরে প্রবল ভিড়। তারই মধ্যে একটি ট্রলিতে পড়ে কাতরাচ্ছে বছর চোদ্দোর এক কিশোর। খালি গা, চোখ বুজে আসছে। হাত ঝুলে পড়েছে ট্রলি থেকে। ছেলের গায়ে কোনও মতে একটি লেপ চাপিয়ে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে বাবা। যদিও লেপ ভিজে যাচ্ছে ওই কিশোরের নিয়ন্ত্রণহীন শৌচকর্মে! মা ছুটে বেড়াচ্ছেন অসুস্থ ছেলেকে দ্রুত ভর্তি করাতে।
এসএসকেএম হাসপাতালের ঠিক পিছনেই ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস’ (বিআইএন) ও এসএসকেএমের একাধিক ভবনে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত ছোটাছুটি করেও অবশ্য সুমন দত্ত নামে স্নায়ুর গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত ওই কিশোরকে ভর্তি করাতে পারেননি বাবা-মা। দক্ষিণ দিনাজপুরের ওই পরিবারকে শেষে জানিয়ে দেওয়া হয়, শয্যা মিলবে না। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ করতে বলা হয়!
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এক বেলা বিআইএনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, সুমনের মতোই পরিণতি হচ্ছে বহু রোগীর। এসএসকেএমের জরুরি বিভাগে গেলে বলা হচ্ছে, ‘‘দেখে বোঝা যাচ্ছে দ্রুত ভর্তি করা দরকার। কিন্তু নিউরোর ব্যাপার, বিআইএনের চিকিৎসকেরাই যা বলার বলবেন।’’ বিআইএনে দীর্ঘ সময় লাইন দেওয়ার পরে বলে দেওয়া হচ্ছে, শয্যা ফাঁকা নেই। রোগীর পরিবার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলে চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এসএসকেএমের জরুরি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিন। পরে এখানে নিয়ে আসা যাবে।’’ রোগীর পরিবার সেখানে গিয়ে ফের শুনছেন, ‘‘এ আবার হয় নাকি! যা করার বিআইএন-ই করবে!’’
অভিযোগ, স্নায়ুরোগের চিকিৎসা নিয়ে সরকারি হাসপাতালে এমন টানাপড়েন অহরহ চলছেই। যার জেরে বেরিয়ে যাচ্ছে রোগীর পরিবারের হাজার হাজার টাকা। অপেক্ষায় থাকার জন্য দ্বিগুণ বা তিন গুণ ভাড়া হাঁকছে অ্যাম্বুল্যান্স। একের পর এক তারিখে অস্ত্রোপচার করাতে না পেরে অনেককেই আবার উঠতে হচ্ছে শহরের মোটা টাকার ভাড়ার ঘরে। তার পরেও বহির্বিভাগে পৌঁছে নির্দিষ্ট চিকিৎসকের খোঁজ করে শুনতে হচ্ছে, তিনি আসবেন কি না, ঠিক নেই। বহু চিকিৎসক আবার সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে বাইরে বেসরকারি কোথাও ‘দেখিয়ে নেওয়ার’ পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনই পরিস্থিতিতে পড়া এক রোগীর আত্মীয় বললেন, ‘‘ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু হাসপাতালগুলোর অবস্থা বদলায় না। বেসরকারি ছেড়েই দিন, সরকারি হাসপাতালেও ঘুরতে ঘুরতে ঘটি-বাটি বেচার অবস্থা হয়।’’
সুমনের বাবা, পেশায় হকার স্বপনকুমার দত্ত যেমন জানালেন, হঠাৎ বুকে ব্যথা ওঠায় গত জানুয়ারিতে ছেলেকে নিয়ে রায়গঞ্জ হাসপাতালে যেতে হয় তাঁদের। সেই সময়ে ওই হাসপাতাল বিআইএনে রেফার করে। বিআইএনে ভর্তি রেখে চিকিৎসা হয় সুমনের। গত ১ ফেব্রুয়ারি ছাড়া পায় সে। ৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ফের দেখাতে আসতে বলা হয়। ওই দিন চিকিৎসককে দেখিয়ে রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে সুমন। শরীরের এক দিক পড়ে যায়। মাঝরাস্তায় নেমেই কলকাতায় আসার অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করেন স্বপনবাবুরা। বিকেলে এসএসকেএমের জরুরি বিভাগে দেখানো হলে জানানো হয়, দ্রুত ভর্তি নেওয়া দরকার। কিন্তু শয্যা ফাঁকা নেই। অভিযোগ, বার বার অনুরোধ করার পরে এক ভবন থেকে আর এক ভবনে ঘুরিয়ে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ জানানো হয়, সকালে বিআইএনের বহির্বিভাগে দেখানো ছাড়া উপায় নেই।
নিরুপায় বাবা-মা এর পরে পিসবোর্ড কিনে ফুটপাতেই ছেলের শোয়ার ব্যবস্থা করেন। স্বপনবাবু বললেন, ‘‘এখানকার ছোট হোটেলেও প্রতি রাতের ভাড়া অন্তত চারশো টাকা। ধার করে ছেলেকে কলকাতায় এনে চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া গুনতে গিয়েই সঙ্গে থাকা সব শেষ। তাই মাটিতেই রাত কাটিয়েছি। দেখেছি, সময় যত যাচ্ছে, ছেলের শরীর একটা দিক অসাড় হয়ে আসছে!’’ সকালে বিআইএনের বহির্বিভাগে লাইন দিয়েও ভর্তি করা যায়নি। বিকেল ৪টে নাগাদ হাসপাতাল বলে দিয়েছে, শয্যা ফাঁকা নেই। শেষে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও একাধিক ভবন ঘুরিয়ে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ সেখানে ভর্তি করানো গিয়েছে সুমনকে। তার মা সুপ্রিয়া দত্ত জানান, ‘‘ছেলেকে ফেলেই রাখা হয়েছে। জানি না, কী হবে!’’
কী হবে, জানা নেই আর এক অসুস্থ রাহুলকুমার সাউয়ের। কাঁকিনাড়ার রাহুলের ডান চোখ ফুলে বেরিয়ে এসেছে। হাঁটা-চলার ক্ষমতা নেই। হুইলচেয়ারে ভাইকে নিয়ে ছোটার মাঝে দাদা রবি বললেন, ‘‘ভাইয়ের টিউমার দেখে কল্যাণী হাসপাতাল বিআইএনে পাঠিয়েছে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের তারিখই মিলছে না। টিউমার ফেটে মারা গেলে কি তারিখ পাওয়া যাবে?’’ আর এক রোগী বুলা দে-র বাড়ির লোকেরও দাবি, ‘‘চিকিৎসক দেখে বলছেন, দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার। মাথার টিউমার পাঁচ মিনিটেই ফেটে যেতে পারে, আবার পাঁচ সেকেন্ডেও ফাটতে পারে। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও শয্যা নেই!’’
বিআইএন তথা এসএসকেএম হাসপাতালের সুপার রঘুনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘বহির্বিভাগে প্রায় ন’হাজার রোগী হয়। জরুরি বিভাগে হয় প্রায় ৬০০। হাসপাতালে সারা দিনে মেরেকেটে শয্যা ফাঁকা হয় ছ’-সাতটি। শয্যা দেওয়া হবে কোথা থেকে?’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘জেলার লোক অসুস্থ হলেই যদি শহরে ছোটেন, এই সমস্যা মিটবে না।’’
(চলবে)