প্রতীকী ছবি।
সাবেক প্রেসিডেন্সি জেলের গভর্নর লিঞ্চ সাহেব ডিনার-পার্টি উপলক্ষে বাড়ির বাইরে ছিলেন। কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা তাঁর সুরম্য আবাসনে স্নানঘরের বাথটবে বিকেল থেকেই লুকিয়েছিল চোরপ্রবর। পরের দিন কাকভোরে সাহেবের ড্রেসিং গাউন, হ্যাটে সেজে তাঁর টাকা-গয়না সাফ করে বেরোনোর সময়েও কিচ্ছুটি টের পাননি রক্ষীরা। উল্টে, ‘সাহেবকে’ সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকে দেন তাঁরা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতার দাগি চোর তথা সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বৈকুণ্ঠের এই কীর্তি লালবাজারের লোকগাথায় পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছে। কারাকর্তার বাড়িতে চুরি করেই জেল পালিয়েছিল সে। পরে ফের উত্তর কলকাতায় চুরি করে ধরা পড়ে। তবে তখন সে ছদ্মনাম নিয়ে ভোল পাল্টে ফেলেছে। অনেক পরে কোনও ইংরেজ গোয়েন্দা বৈকুণ্ঠের আসল নাম-পরিচয় জানতে পারেন।
যে কোনও বড় শহরের উত্থান বা বিস্তারের ইতিহাস তার চোরেদের ইতিহাসও বটে। করোনা-প্রতিরোধে তালাবন্দির শহরে আরও অনেক কিছুর মতো এই চুরিবিদ্যার কারখানাতেও কার্যত তালা ঝুলে গিয়েছে। নিউ আলিপুরে বাজার ফেরত এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন হাতিয়ে ধরা পড়ার ঘটনাটি ঠিক আদর্শ ‘কপিবুক’ চুরির গোত্রে ধরছেন না লালবাজারের কর্তারা। ধ্রুপদী চুরি মানে, বাড়িতে নিঃশব্দ অপারেশন। তেমন চুরির মতো চুরি গত হপ্তা দুয়েকে একটিও ঘটেছে বলে মনে করতে পারছেন না লালবাজারের কর্তারা।
প্রধানমন্ত্রীর জনতা কার্ফু থেকে রাজ্য বা কেন্দ্রের লকডাউন ঘোষণার পরে কলকাতায় খাতায়-কলমে চুরির সংখ্যা খান ছয়েক। যেমন নারকেলডাঙায় দুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে গৃহকর্তা দেখেন, ছুটে পালাচ্ছে এক খুদে চোর। সে তখনই ধরা পড়ে। পর্ণশ্রীতে জানলা থেকে মোবাইল চুরির অভিযোগ এসেছে বলেও লালবাজার সূত্রের খবর। করোনা-দুর্বিপাকে নিউ আলিপুরে জেল থেকে জামিনে মুক্ত সুমন ছেত্রীর ‘কুকাজও’ ঘটত না, বলছেন পুলিশকর্তারা। অভিযুক্ত সুমন বেহালার বাসিন্দা।
কৃষ্ণনগর জেল থেকে ছাড়ার পরে তাকে গাড়িতে করে তারাতলার মোড়ে নামিয়ে দেওয়া হয় বলে আক্ষেপ কলকাতা পুলিশের। নেট-জালিয়াতি বা সাইবার অপরাধের রমরমায় তিন-চার বছরে গায়ে-গতরে খেটে চুরি এমনিই কমেছে শহরে। গোয়েন্দাকর্তাদের দাবি, মাসে এখন গড়ে ৩৫-৪০টি চুরি হয় কলকাতায়। কলকাতার প্রথম পুলিশ কমিশনার এস ওয়াশপের
১৮৭২ সালের রিপোর্টে শহরের বাড়িতে চুরি ও রাস্তায় ছিনতাই হু হু করে বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৮৫১ থেকে ১৮৭১-এর মধ্যে বাড়িতে চুরির ঘটনা ৫১টি থেকে বেড়ে হয় ১৬৯টি। তখনও আনকোরা শহর কলকাতায় যা খানিক সমৃদ্ধিরও সূচক।
লালবাজারের দাবি, চোরেদের একটা বড় অংশই বহিরাগত। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে নৈহাটি, ক্যানিং কিংবা ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে ঢুকে চুরির সুযোগ কোথায়! ঘরে-বাইরে সিসি ক্যামেরার জমানায় চুরি অনেক কঠিন হয়েছে। গায়ে তেল মাখা, মুহূর্তে সটকে পড়তে ওস্তাদ সিঁধেল চোরের যুগ স্বভাবতই অতীত। আজকের চোরেরা ভদ্রবেশী। সেলসম্যান বা কোনও অফিস-কর্মচারীর ভেক ধরে দুপুরে ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢোকে। কোন ফ্ল্যাটে গৃহিণী সন্তানকে স্কুল থেকে আনতে বেরিয়েছেন খেয়াল করে তালা ভেঙে দ্রুত অপারেশন। রাতের থেকে দিনদুপুরই চুরি-শিল্পের মোক্ষম লগ্ন।
লালবাজারের দাবি, সিঁথির এটিএম ভেঙে চুরির অভিযুক্তদের মতো পাকা চোরেদের অনেককে জেলে রেখে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা গিয়েছে। সেটাই যা রক্ষে! মাদকাসক্ত কিছু চেনা চোরকে সরকারি নৈশাবাসে ভাত-ডাল খাইয়ে বাবা-বাছাও করছেন পুলিশ অফিসারেরা। চুরি ছেড়ে এখন বড়বাজারে ফল বিক্রি করেন এক পুরনো চোর। রবিবার তাঁকে ফোনে সতর্ক করলেন জনৈক পুলিশকর্তা। ‘‘কার বাড়িতে কী অসুখ! চুরি পরেও করতে পারবি। এখন দূরে দূরে থাক।”
চুরি নেই। তবে শান্তিও নেই। আপনি বাঁচলে চুরির কাম, বলছে দমবন্ধ কলকাতা।