theatre artist

নাট্যকর্মীদের দুর্দশা ঘোচাতে আসরে বিজেপি

আগামী ১৭ জানুয়ারি কালীঘাটের যোগেশ মাইম হলের আলোচনাচক্রের বিষয়টি অবশ্য অন্য রকম।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২১ ০২:২৯
Share:

নাট্যকর্মীদের বিক্ষোভ। সম্প্রতি তপন থিয়েটারের সামনে। নিজস্ব চিত্র

বাংলা গ্রুপ থিয়েটার ফের এক চ্যুতি বা ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে। নাট্যজগতে এ রকম মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে। রাজনৈতিক ও দার্শনিক কারণে বিজন ভট্টাচার্য, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী হয়ে হাল আমলের গৌতম হালদার বা ব্রাত্য বসু— অনেকেই আগের নাট্যদল ভেঙে বেরিয়ে তৈরি করেছেন নতুন দল। ওয়াকিবহাল লোকজন জানেন, এই দল ভাঙাভাঙি গ্রুপ থিয়েটার ও লিটল ম্যাগা‌‌জ়িনের প্রবহমান এক বৈশিষ্ট্য।

Advertisement

আগামী ১৭ জানুয়ারি কালীঘাটের যোগেশ মাইম হলের আলোচনাচক্রের বিষয়টি অবশ্য অন্য রকম। ‘দ্য লিবারাল থিয়েটার কনফেডারেশন’ নামে নতুন এক সংগঠনের জন্ম এবং থিয়েটারের শিল্পী, কলাকুশলীদের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা। সংগঠনের আহ্বায়ক পার্থপ্রতিম দেব জানালেন, ওই সভায় রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, প্রাক্তন সাংসদ অনুপম হাজরাও উপস্থিত থাকবেন। এর আগে স্বাভাবিক সময়ে নাটকের লোকেরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা করেছেন। কিন্তু একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতিতে কখনও এমন ভাবে নাট্য সংগঠন তৈরি হয়নি। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তদের আমলে নয়। এমনকি, তৃণমূলের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বা রাজ্যসভার সাংসদ অর্পিতা ঘোষেরা বছর কয়েক আগে যখন তাঁদের ক্ষণস্থায়ী নাট্যস্বজন তৈরি করেছিলেন, তখনও নয়। আহ্বায়ক পার্থ এর আগে নান্দীকারের নাচনী, বাঘা যতীন আলাপের সাগিনা, গয়নার বাক্স ইত্যাদি নাটক পরিচালনা করেছেন। এ বার অন্য পথে।

‘অন্য পথ’ শব্দটায় অবশ্য পার্থ ও তাঁর সহযোদ্ধাদের আপত্তি আছে। ‘‘আমরা কোনও নতুন দল তৈরি করছি না। কে কেমন নাটক করবেন, কোন অনুদান পাবেন, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথাও নেই। আমরা দেখেছি, লকডাউনের পরে নাটকের লোকেরা কী ভাবে অনাহারে, অর্ধাহারে ছিলেন। সেই অবস্থা কাটাতেই আমাদের এই প্রয়াস,’’ বলছিলেন পার্থ। তাঁর দাবি, সারা রাজ্যের প্রায় ৬৮০টি নাট্যদল তাঁদের সঙ্গে আছে। বেশির ভাগই গ্রাম-গঞ্জ, মফস্সলের ছোট দল। পার্থরা জানালেন, তাঁদের সংগঠনে সব চেয়ে বেশি নাট্যদল এসেছে সুন্দরবন এলাকা থেকে, প্রায় ৪০টি। তার পরেই বীরভূম জেলা। সেখানকার ৪০টির মধ্যে ১৭টি নাট্যদলই তাঁদের সঙ্গে আছে।

Advertisement

লকডাউনে অনাহার আর অর্ধাহারই তা হলে বাংলা নাটকের একাংশকে বিজেপির কাছাকাছি নিয়ে এল? ওই সময়েই রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে রানাঘাটের তরুণ নাট্যকর্মী প্রসেনজিৎ চক্রবর্তীর আত্মহত্যা। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে, নাটক করে শখ মেটালেও পেট মানছিল না। সেই ঘটনার পরে বিভাস চক্রবর্তী এক নাট্য পত্রিকায় প্রশ্ন তুলেছেন, নাটকে এত জৌলুস, তারকা, স্যালারি গ্রান্ট থেকেও ছেলেমেয়েদের এ ভাবে অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে কেন? নাটকের অর্থনীতি নিয়ে এ বার অন্য ভাবে ভাবার সময় এসে গিয়েছে।

কিন্তু বিজেপির ছত্রচ্ছায়ায়? পার্থদের বক্তব্য, কারও ছত্রচ্ছায়া নয়। নাটকের দলও নয়। এটা নাটকের দল, ব্যাক স্টেজ, অভিনেতা— সবাইকে নিয়ে একটা সংগঠন। এটা ঘটনা যে, এই অতিমারি আবহে নাটকের অবস্থা এখন সব চেয়ে বেশি খারাপ। রবীন্দ্র সদন, মধুসূদন মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চ— সব ক’টি সরকারি হলই এখন বন্ধ। আলো, মেক-আপ ও সেটের নেপথ্য শিল্পীদের সঙ্গিন অবস্থা। সপ্তাহের শুরুতে তপন থিয়েটার খোলার দাবিতে নাট্যকর্মীদের একটি মিছিলও ছিল। তবে সরকারি স্তরে ভয়, হল খুললে যদি সংক্রমণ ছড়ায়! আর নেপথ্য শিল্পীদের বক্তব্য, তাঁরা কী খাবেন!

শোচনীয় অবস্থা লকডাউন থেকেই। নাট্যকর্মীরা নিজেদের মতো অবস্থা সামাল দিচ্ছিলেনও। কৌশিক সেন, দেবশঙ্কর হালদার, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়রা সেই সময়ে নাট্যকর্মীদের সাহায্যার্থে ‘সৌভ্রাতৃত্ব’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ‘‘আমরা এখনও ২০০ জনের বেশি নেপথ্য শিল্পীকে মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দিচ্ছি। রেশনের ব্যবস্থা করেছি। একটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁদের ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি,’’ বললেন কৌশিক। একই কথা ব্রাত্যজনেরও। বালিগঞ্জ ব্রাত্যজনের তরফে বিজয় মুখোপাধ্যায় জানালেন, তাঁরাও মে থেকে অগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি হলে কর্মীদের চাল, ডাল, সয়াবিন, আলু দিয়েছেন। কিন্তু মাসে ১০ কেজি চাল আর পাঁচ কেজি ডালে কার সংসার চলে?

এরই মধ্যে অভিমান পুঞ্জীভূত হয় আর একটি ঘটনায়। আমপানের পরে অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তেরা ‘নাট্যসংহতি’র তরফে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে ৬ লাখ টাকা সাহায্য করেন। ‘‘টাকাটা দেওয়ার আগে কেউ কিছু বলল না, দেওয়ার পরে সবাই ফেসবুকে আক্রমণ শুরু করল। আমরা কোনও রাজনৈতিক দলকে দেব না ভাবাই ছিল,’’ বললেন মেঘনাদ। কিন্তু পার্থদের এখনও বক্তব্য, থিয়েটারের জন্য তোলা টাকা সরাসরি থিয়েটার কর্মীদের দিলেই ভাল হত।

এ সব নিয়েই নাট্যমহলে জল ঘোলা। কিন্তু বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তের নাট্য পৃথিবীতে বিজেপি! ‘‘ওঁরা নিজেরা আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। রাজনীতিকে এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। অনুদান দিল্লি থেকেই আসে। আর দলগুলিকেও কেন্দ্রের আইনেই রেজিস্ট্রি করতে হয়,’’ বললেন ইতি থিয়েটারের সৃজিত ঘোষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement