বড়দিন উপলক্ষে আলিপুর চিড়িয়াখানায় দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে বেলুন নিয়ে খেলছিল দুই বালক। শীতের পোশাক গায়ে নয়, তা বাঁধা দু’জনের কোমরে। বেশ কিছু ক্ষণ ছোটাছুটি করার পরে দু’জনের গা দিয়েই তখন ঘাম গড়াচ্ছে। পাশে গাছের ছায়ায় বসে থাকা মা-বাবা বারণ করছিলেন ছোটাছুটি করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কিছু ক্ষণ পরে ধমকে উঠলেন বাবা, ‘‘গরমে সবাই ঘামছে! আর তোরা রোদের মধ্যে ছুটছিস? গায়ে ঘাম বসে শরীর খারাপ করলে কী হবে?’’
সোমবার, বড়দিনের দুপুরে শুধু ভিক্টোরিয়া চত্বরই নয়, প্রিন্সেপ ঘাট থেকে চিড়িয়াখানা— সর্বত্র ছিল একই ছবি। সকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডার বদলে অকাল গরমের সাক্ষী থাকল শহর। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড়ে নাজেহাল হয়ে অনেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘এটা সত্যি সত্যি শীতকাল তো? দিনের বেলায় তো গায়ে সোয়েটার, চাদর রাখাই যাচ্ছে না।’’
আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালের দিকে তাপমাত্রা ছিল ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রির আশপাশে। ভোরের দিকে যদি বা কিছুটা শিরশিরানি অনুভূত হয়েছিল, তা উধাও হয়ে যায় বেলা বাড়তেই। দুপুরে শহরের তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করেছে ২৬ ডিগ্রির আশপাশে। গত বছরেও ২৫ ডিসেম্বর একই রকম গরম অনুভূত হয়েছিল। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৮.৭ ডিগ্রি। হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, সাধারণত এই সময়ে দিনের তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও এ বছর ঘূর্ণাবর্তের কারণে বড়দিনের তাপমাত্রা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।
তবে, অকাল গরমকে উড়িয়েই প্রবল উৎসাহে সব দ্রষ্টব্য স্থানের দখল নিয়েছিল জনতা। আলিপুর চিড়িয়াখানা, প্রিন্সেপ ঘাট, সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল থেকে শুরু করে ভারতীয় জাদুঘর, আলিপুর জেল মিউজিয়াম— সর্বত্রই দেখা গিয়েছে জনসমুদ্র।
বেলায় চিড়িয়াখানার সামনে গিয়ে দেখা গেল, টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইন চলে গিয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার ছাড়িয়ে। তারই মধ্যে ‘লাইন সোজা করুন, লাইন সোজা করুন’ বলে পুলিশকর্মীদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
চিড়িয়াখানার টিকিট কাউন্টারের লাইনে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর বিরক্তি তখন মাত্রা ছাড়িয়েছে। বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম, সকাল সকাল চিড়িয়াখানা দেখে আশপাশে একটু ঘুরব। কিন্তু যা অবস্থা, তাতে তো মনে হচ্ছে, চিড়িয়াখানার ভিতরে ঢুকতেই সব শক্তি শেষ হয়ে যাবে।’’ ভিড় সামলাতে এ দিন নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই চিড়িয়াখানার গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল বলে খবর। ভিড় যত বেড়েছে, ততই ওই এলাকায় বেড়েছে গাড়ির জট।
একই ছবি ছিল ময়দান চত্বরে। দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে টিকিট কাটার লাইন চলে যায় কয়েকশো মিটার। উপচে পড়া ভিড় ছিল সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালেও। গল্ফ গ্রিন থেকে বন্ধুর সঙ্গে সেখানে এসেছিলেন রিচা ভট্টাচার্য। বন্ধুদের সঙ্গে নিজস্বী তোলার ফাঁকে বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম, গির্জার সামনের মাঠে একটু বসব। কিন্তু দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও পাচ্ছি না!’’
চিড়িয়াখানা ঘুরে অনেকেই বিশ্রাম নিতে গঙ্গার ধার বেছে নিয়েছেন এ দিন। কৃষ্ণনগর থেকে সপরিবার ঘুরতে আসা আবির পাত্র বললেন, ‘‘গরমে চিড়িয়াখানা ঘুরে ক্লান্ত। গঙ্গার হাওয়ায় একটু আরাম লাগছে। বিকেলে ভিক্টোরিয়া ঘুরে বাড়ি ফিরব।’’
এটা যদি হয় সকাল ও দুপুরের চিত্র, তা হলে বিকেল থেকে সব ভিড় আছড়ে পড়তে শুরু করে পার্ক স্ট্রিটে। একটা সময়ে রাসেল স্ট্রিট, লিটল রাসেল স্ট্রিট, মিডলটন স্ট্রিটে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। শুধু কালো মাথা দেখা দিয়েছে রেস্তরাঁ ও পানশালাগুলির সামনে।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়িয়েছে, ততই পার্ক স্ট্রিট কার্যত ‘ওয়াকিং স্ট্রিটে’ পরিণত হয়েছে। অ্যালেন পার্কের সামনে ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে এক তরুণী বললেন, ‘‘ভিড় একটু কম হবে ভেবে রাত করে এলাম। কিন্তু তাতে তো দেখছি উল্টো বিপদ! কয়েকশো মিটার রাস্তা পেরোতেই এক ঘণ্টা লেগে গেল।’’
বাঁধভাঙা ভিড়ের আন্দাজ করে আগে থেকেই ওই এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছিল লালবাজার। একাধিক ওয়াচ-টাওয়ার থেকে চলেছে নজরদারি। মোতায়েন ছিল সাদা পোশাকের পুলিশও। রাতে পার্ক স্ট্রিটের পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান কলকাতার নগরপাল বিনীত গোয়েল। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয় রাসেল স্ট্রিট, লিটল রাসেল স্ট্রিট এবং মিডলটন স্ট্রিটে।
পুলিশের একাংশের দাবি, এ বছরের ভিড় গত বছরকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ভিড় সামলাতে সামলাতে বিরক্ত হয়ে এক পুলিশকর্মী বলে উঠলেন, ‘‘কাতারে কাতারে মানুষ শুধু হেঁটে যাচ্ছে। এখানে কী মজা আছে কে জানে!’’