অন্য শহর / ফার্সি চর্চা

শহরে ফার্সি ভাষার নীরব চর্চার পঁচাত্তর পার

অথচ যে ভাষার এত প্রভাব বাংলায়, তার সে ভাবে চর্চাই নেই এ শহরে! তাই ফার্সিতে আবুল ফজলের আকবরনামা পড়তে শহর ঢুঁড়ে দু’এক জনের খোঁজ মেলে।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৩৩
Share:

ঐতিহ্য: দুষ্প্রাপ্য বইয়ে সমৃদ্ধ সেই পাঠাগার (১ এবং ২)। সিন্ধু সভ্যতার লিপির বই (৩)। ছবি: সুমন বল্লভ

বাংলা ভাষা থেকে ফার্সি শব্দগুচ্ছ মুছতে হলে ‘পছন্দ’ ত্যাগ করতে হবে। ‘রাস্তা’, ‘দোকান’ বন্ধ করতে হবে। ‘জায়গা’ বদলাতে হবে। ‘বাগান’ সরাতে হবে। ‘খারাপ’ লাগলেও ‘দেরি’ না করে ‘চাকরি’ ছাড়তে হবে। ‘দম’ বন্ধ মনে হলেও ‘রোজ’ ‘আয়না’ দেখা ছাড়তে হবে। ‘আন্দাজের’ উপরে নির্ভর নয়। ‘আওয়াজ’ তুলতে হবে। ‘খুব’ ‘গরম’ চলবে না। বদলে ফেলতে হবে ‘আবহাওয়া’। এমন প্রায় পাঁচ হাজার ফার্সি শব্দকে ‘আরামে’ পাঠাতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এ দেশে মুসলমান শাসনকালে ফার্সি ভাষাই ছিল দেশের রাজভাষা। সেই শুরু। ‘আস্তে’ ‘আস্তে’ বাংলা ভাষার অন্দরে মধু যোগ করে অপরিহার্য এর অস্তিত্ব।

Advertisement

অথচ যে ভাষার এত প্রভাব বাংলায়, তার সে ভাবে চর্চাই নেই এ শহরে! তাই ফার্সিতে আবুল ফজলের আকবরনামা পড়তে শহর ঢুঁড়ে দু’এক জনের খোঁজ মেলে। এই দু’এক জনের খোঁজ পাওয়ার পিছনে জড়িয়ে রয়েছে অন্য ইতিহাস। ফার্সি ভাষার চর্চা যাতে বজায় থাকে, তাই ১৯৪৪-এর অগস্টে তৈরি হয়েছিল ইরান সোসাইটি। যার প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন কংগ্রেসের সদস্য এম ইশহাক। ১৮৯৮-এ কলকাতায় জন্ম তাঁর। ইংল্যান্ডে পড়ার সময়ে লন্ডনের ইরান সোসাইটিকে দেখে এ শহরে ফার্সি ভাষার চর্চার জন্য ভাবনা হয় ইশহাকের।

কলকাতায় ফিরে বন্ধু এম এইচ কাশানির মতো ঘনিষ্ঠদের কাছে সে কথা জানানও তিনি। এগিয়ে আসেন পার্সি এবং আর্মেনীয় ব্যবসায়ী বন্ধুরা।

Advertisement

পাশে পান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকারের মতো আরও অনেক বাঙালিকে। সমর্থনে এগিয়ে আসেন তাঁর বড় ভাই আব্দুল হালিম, যিনি সেই সময়ে কলকাতা পুরসভার অল্ডারম্যান ছিলেন। ১৫৯-বি ধর্মতলা স্ট্রিটের বাসভবনের সভায় জন্ম হল ইরান সোসাইটির। ১৯৫১ সালে ১০২ প্রিন্সেপ স্ট্রিটে গেলেও ফের প্রথম ঠিকানায় ফিরে যায় সোসাইটি। ১৯৬০-এর সেপ্টেম্বরে ১২ কিড স্ট্রিটের এই বাড়ি এক মুসলিম পরিবারের থেকে কিনে নেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে সেখানেই সোসাইটির দ্বারোদ্ঘাটন করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর। আজও একই ঠিকানায় চলছে সোসাইটি। ইশহাকের মৃত্যুর পরে ১৯৭১ থেকে রাস্তাটি তাঁর নামেই হয়।

এই বাড়িটির এক অন্য ইতিহাস রয়েছে। শহরের স্মৃতিচারণে যার উল্লেখ জরুরি। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮২৮ সালের তথ্য বলছে, এর মালিক জেমস বারওয়েল। ১৮৩৩-এ মালিকানা বদলে এডওয়ার্ড উইলকিনসনের হাতে আসে। তখন এর প্রেমিসেস নম্বর ছিল ৪। তথ্য বলছে, ১৮৬৮ সালে প্রেমিসেস নম্বর বদলে হয় ১২। কে এই বারওয়েল? এইচ ই এ কটনের ‘ক্যালকাটা ওল্ড অ্যান্ড নিউ’ গ্রন্থে তাঁর হদিস মেলে। সেন্ট জন্স চার্চে তাঁর সমাধির স্মৃতিফলকে উল্লেখ, ১৮৩৩ সালে ৪৯ বছরে মৃত্যু হয়েছিল এই বেঙ্গল সিভিল সার্ভেন্টের। তাঁর আরও একটি পরিচয়, তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশ্বস্ত সঙ্গী রিচার্ড বারওয়েলের ছেলে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্বে এই ভবনের গোপন কক্ষে বৈঠক করেছেন ভগৎ সিংহও। সেখানে এখন রাখা দুষ্প্রাপ্য বই। রয়েছে গ্রন্থাগার এবং সেমিনার কক্ষ। ৬০০০ দুষ্প্রাপ্য বই, যার অর্ধেক ইশহাকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। ফার্সি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা বইও আছে। রয়েছে একাধিক জার্নাল, সিন্ধু সভ্যতার লিপি সংবলিত বই, ইরানের প্রায় অবলুপ্ত ভাষা অভেস্তায় লেখা বই। তবে এ সব পড়তে ইরান সোসাইটিকে মেল করে অনুমতি নিতে হয়।

সোসাইটির সদস্য এম ইশহাকের সম্পর্কে পৌত্র ও বিধানসভার স্পিকার প্রয়াত হাসিম আব্দুল হালিমের ছেলে ফুয়াদ হালিম জানালেন, ইরান সোসাইটির উদ্দেশ্য ফার্সি ভাষার চর্চাকে ধরে রাখা, এ জন্য সপ্তাহে তিন দিন এখানে ফার্সি ভাষা শেখানো হয়। শুরু থেকে ইন্দো-ইরানিকা নামে একটি ত্রৈমাসিক ইংরেজি ও ফার্সি ভাষার জার্নাল নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। এবং সেই জার্নাল এখনও নীরবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।

শহরে ফার্সি ভাষার চর্চায় এ ভাবেই ইতিহাসের পরতে আরও এক ইতিহাস জেগে রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement