সৌরভ সাহা রায়।
সকালে গঙ্গাস্নানে এসে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা। ঘাটের সামনে একটি স্কুটার, তাতে ডাক্তারের লোগো। সিঁড়িতে পড়ে রয়েছে জুতো, জামা-প্যান্ট ও তোয়ালে। কিন্তু গঙ্গায় কাউকে স্নান করতে দেখা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষণ পরে তাঁরা খেয়াল করলেন, ঘাটের কিছুটা দূরেই জলে ভাসছে এক যুবকের দেহ। খবর পেয়ে পুলিশ এসে দেহটি উদ্ধার করে। তদন্তে জানা যায়, ওই যুবকের সঙ্গে তাঁর এক বন্ধুও ছিলেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত তাঁর খোঁজ মেলেনি।
শনিবার ঘটনাটি ঘটেছে বেলুড়ের লালাবাবু সায়র রোডের জগন্নাথ ঘাটে। পুলিশ জানায়, উদ্ধার হওয়া মৃত যুবকের নাম সৌরভ সাহা রায় (২৫)। তিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। নিখোঁজ যুবকের নাম রোহন কুমার (২৪)। তিনি ফিল্ম স্টাডিজ় নিয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, এ দিন ভোর চারটে নাগাদ ওই দুই যুবক জগন্নাথ ঘাটে এসেছিলেন। তার পরে স্নান করতে নেমে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন বলে অনুমান তদন্তকারীদের। পুলিশকর্তারা জানিয়েছেন, রোহনের ছবি আশপাশের সমস্ত থানায় পাঠানো হয়েছে। গঙ্গাতেও খোঁজ চালাচ্ছেন বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা। এ দিন সকালে স্থানীয় ডুবুরি বীরেন কর্মকার ঘটনাস্থলে এসে খোঁজ করলেও কিছু পাননি।
পুলিশ জানায়, এ দিন সকালে খবর পেয়ে ওই ঘাটে এসে তারা দেখে, দু’টি সিঁড়িতে দুই জোড়া জুতো পড়ে আছে। জামা-প্যান্টের সঙ্গেই পাওয়া যায় একটি মানিব্যাগ ও একটি মোবাইল। সেই ব্যাগ থেকেই সৌরভের পরিচয়পত্র (ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের আইডি কার্ড) মেলে। সেখান থেকে ঠিকানা জানতে পেরে বেলুড় বাজার এলাকায় সৌরভের ফ্ল্যাটে আসেন বেলুড় থানার তদন্তকারীরা। তখনই জানা যায়, এ দিন ভোরে সৌরভের সঙ্গে ছিলেন রোহনও। তিনি নিখোঁজ। প্রতিবেশীরাই প্রাথমিক ভাবে সৌরভের দেহ শনাক্ত করেন। রোহনের জামা-প্যান্ট শনাক্ত করেন পরিজনেরা।
সৌরভ বছর তিনেক আগে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। তাঁর বাবা সুধাংশু সাহা রায়ও পেশায় চিকিৎসক। চাকরি সূত্রে তিনি কার্শিয়াংয়ে থাকেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানেই থাকতেন সৌরভ। কয়েক দিন আগে মামার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বৈষ্ণোদেবী গিয়েছিলেন। সেই কারণেই বেলুড়ের ফ্ল্যাটে থাকছিলেন। তাঁর মামিমা সুদীপ্তা সাহা দাস বলেন, ‘‘তিন দিন আগে আমরা বৈষ্ণোদেবী দর্শন সেরে ফিরেছি। সৌরভ সম্প্রতি এমডি পাশ করেছিল। সামনেই ওর কাউন্সেলিং ছিল। সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করবে বলে বেলুড়ে থেকে গিয়েছিল।’’ এ দিন খবর পেয়ে ভবানীপুর থেকে বেলুড়ে চলে আসেন সুদীপ্তা। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘‘ও সাঁতার জানত না। তা-ও ভোরবেলা কেন গঙ্গায় গেল, বুঝতে পারছি না।’’
সৌরভের ফ্ল্যাটের উপরতলাতেই থাকেন রোহন। ছোট থেকেই তাঁরা বন্ধু। এ দিন ঘটনার খবর পেয়ে ভেঙে পড়েছেন তাঁদের পড়শিরাও। রোহনদের ফ্ল্যাটের উল্টো দিকেই থাকেন স্বপনকুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘‘রোহন ও সৌরভ ছোট থেকে একসঙ্গেই বড় হয়েছে। পরে সুধাংশুবাবু চাকরি সূত্রে উত্তরবঙ্গে চলে যান। তখন সৌরভেরাও সেখানে যায়।’’ জানা গিয়েছে, একা ছিলেন বলে রোহনকেও ডেকে নিয়েছিলেন সৌরভ। তাঁকে নিয়ে নিজের স্কুটারে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছন। এ দিন বেলুড়ের ওই আবাসনে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনার খবর শোনার পর থেকেই বাক্যহারা রোহনের বাবা অশ্বিন কুমার। তাঁর মাকে কিছু জানানো হয়নি। জানা গিয়েছে, রোহনও সাঁতার জানেন না।
প্রতিবেশীরা জানান, খবর পেয়ে কার্শিয়াং থেকে বেলুড়ে আসছেন সৌরভের মা-বাবা। তাঁদের মেয়ে, অর্থাৎ সৌরভের বোনও ভিন্ রাজ্যে ডাক্তারি পড়ছেন। তিনিও বেলুড়ে আসছেন। গায়ত্রী সাহা নামে এক প্রতিবেশী বললেন, ‘‘শুক্রবার রাতেও সৌরভ এসে চা খেল। পেঁয়াজ চেয়ে নিয়ে গেল। তার পরে সকালে পুলিশ আসতে দুঃসংবাদটা পেলাম।’’ অত ভোরে কেন ওই দু’জন আচমকা স্নান করতে গঙ্গায় গেলেন, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। পরীক্ষা করা হচ্ছে রাস্তা ও গঙ্গার ঘাটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও।