দেশের সেরা গ্রাম পঞ্চায়েতের সম্মান পেয়েছিল দিগম্বরপুর। রবীন্দ্রনাথ যত্নে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি। — নিজস্ব চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের শেষবেলার প্রচারে জোর তৎপরতা রাজ্য জুড়ে। মনোনয়ন পর্ব থেকেই বার বার উত্তেজনার খবর আসছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে। অথচ সেই জেলাতেই রয়েছে এক শান্ত গ্রামীণ এলাকা। যা গোটা দেশের কাছে ‘মডেল’। সেখানেও ভোটের লড়াই রয়েছে। কিন্তু সেটা পাঁচ বছরে এক বার। তা বাদ দিলে সারা বছর সেখানে চলে উন্নয়নের লড়াই।
কলকাতা থেকে পাথরপ্রতিমার দূরত্ব নয় নয় করে ১০০ কিলোমিটার। সুন্দরবনের জল-জঙ্গল এলাকার গ্রাম দিগম্বরপুর। কিন্তু খ্যাতির দিক থেকে পিছিয়ে নয় এই গ্রাম। ২০১৮ সালে ‘দেশের সেরা’ গ্রাম পঞ্চায়েতের মর্যাদা পেয়ে অখ্যাত দিগম্বরপুর খ্যাতি পেয়েছিল। তখন পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বেরা। বিদায়ী উপপ্রধান রবীন্দ্রনাথ এ বারও প্রার্থী হয়েছেন পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার জন্য। দিনরাত এক করে প্রচার করছেন। তার ফাঁকেই আনন্দবাজার অনলাইনকে শোনালেন ২০১৮ সালের গল্প। সে বারেই দেশের সেরার মুকুট পেয়েছিল বাংলার দিগম্বরপুর।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই গ্রামীণ বিকাশে জোর দিয়েছিলেন। তাঁর আমলে পঞ্চায়েতিরাজ মন্ত্রক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরা পঞ্চায়েত বাছাই করে পুরস্কার দেওয়া শুরু করে। ২০১৮ সালে প্রথম বার বাছাই হয় দেশের সেরা পঞ্চায়েত। প্রথমে দেশের আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় যায় ১৪৪টি। শেষে সেরা তিনের নাম ঘোষণা হয়। এক নম্বরে ছিল পশ্চিমবঙ্গের দিগম্বরপুর। দ্বিতীয় কর্নাটকের মলঙ্গি আর তৃতীয় সিকিমের মণিরাম ফলিধারা গ্রাম পঞ্চায়েত।
ফলপ্রকাশ হয়েছিল গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে। বিচার হয়েছিল ২০১৬-’১৭ আর্থিক বছরে কোন পঞ্চায়েত কেমন কাজ করেছে তার ভিত্তিতে। তাঁর গ্রাম পঞ্চায়েত সেরা নির্বাচিত হওয়ার পরে মধ্যপ্রদেশে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে মোদী সরকারের তৎকালীন পঞ্চায়েতিরাজ মন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে পেয়েছিলেন এলাকার উন্নয়নের জন্য ২০ লক্ষ টাকা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার পাওয়া পঞ্চায়েতের প্রধানদের সঙ্গে উঠেছিল মোদীর গ্রুপ ছবি। সেরা পঞ্চায়েতের প্রধান রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েছিলেন মোদীর ঠিক পিছনেই। সেই ছবি এখনও যত্নে রাখা রবীন্দ্রনাথের কাছে। এই ভোটে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ মোদীর দল বিজেপি। তবুও। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘‘আমায় পুরস্কার দিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিজেপির নেতা নন। ওই পুরস্কার আমরা জিতেছিলাম নিজেদের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। সেখানে তো কোনও রাজনীতি নেই। দেশের সব পঞ্চায়েতকে পিছনে ফেলে দেওয়া তো কম কথা নয়। আমি তো মনে করি শুধু দিগম্বরপুর নয়, আমরা গোটা বাংলার জন্যই গর্ব নিয়ে এসেছিলাম।’’
মোদী তথা কেন্দ্রের হাত থেকে ছাড় পাননি রবীন্দ্রনাথ। ২০১৯ সাল থেকে তিনি ডাক পেতে থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সঠিক ভাবে পঞ্চায়েত চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। গত মাসেই ঘুরে এসেছেন রাঁচি থেকে। তার আগে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে।
এই সেই ছবি। নরেন্দ্র মোদীর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বেরা। — নিজস্ব চিত্র।
ধোলাহাট থানার অন্তর্গত দিগম্বরপুর একটা সময় পর্যন্ত খুব উন্নত গ্রাম ছিল না। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বেরা ছিলেন কৃষক। মা-ও সংসারের সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। মাধ্যমিক পাশ করার পরে আর লেখাপড়া করা হয়নি রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু এখন তাঁকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। পঞ্চায়েত নিয়ে বক্তৃতা করতে হয়। নিজের উদ্যোগে ইংরেজি আর হিন্দি শিখেছেন। এখন বাংলার মতোই ওই দু’টি ভাষাতেও স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন।
তৃণমূল করছেন গোড়া থেকেই। বাম আমলে দু’বার পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে জিতে প্রধান। ২০১৮ তে জিতে উপপ্রধান। এ বার জিততে পারলে পঞ্চমবার সদস্য হবেন রবীন্দ্রনাথ। দাবি করলেন, ‘‘আমি একা নয়, আমরা সবাই জিতব। আমাদের পঞ্চায়েতে প্রার্থী অনেকেই রয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল ছাড়া কেউ জিততে পারবে না। আসলে সারা বছর কাজের নিরিখেই মানুষ আমাদের ভোট দেবেন।’’
পঞ্চায়েত নির্বাচনে তো এ বার অনেক সমস্যা? কেন্দ্রীয় সরকার টাকা আটকে দেওয়ায় মানুষের মনে ক্ষোভ নেই? রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আমাদের গ্রামের মানুষ জানেন, পঞ্চায়েতের কাজ কতটুকু। তাতে একটুও ফাঁকি নেই। এখানে বাড়তি জব কার্ডের কথা কেউ বলতে পারবে না। আর আবাস যোজনা নিয়ে কোনও দুর্নীতির গন্ধ নেই দিগম্বরপুরে। যত বার কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল এসেছে, আমাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে গিয়েছে।’’
তবে কেন্দ্রের কাজ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের। তিনি বলেন, ‘‘কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে টাকা আটকে রাখা হয়েছে। যাঁরা ঠিক মতো কাজ করেছেন, তাঁদের টাকাটা দিয়ে দেওয়া উচিত। আবার যে প্রকল্পে কোনও সমস্যা নেই, তার টাকাও মিটিয়ে দিলে ভাল হয়। আসলে সকলে তো সমান নয়। তাই সব কিছু সমান করে দেখাও উচিত নয়। যে সব পঞ্চায়েত সঠিক হিসাব পেশ করেছে, তাদের টাকা ছেড়ে দেওয়া উচিত।’’ একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, ‘‘আমরা যে বার সেরা হলাম, সে বার প্রকল্প তৈরি, রূপায়ণ এবং চতুর্দশ অর্থ কমিশনের টাকা খরচ-সহ কয়েকটি বিষয় ছিল প্রতিযোগিতার মূল মাপকাঠি। সেটা এখনও সমান ভাবে পালিত হয়। এখানে সব সিদ্ধান্তই হয় গ্রাম সংসদের বৈঠকে।’’
২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দিগম্বরপুর ছাড়াও হাওড়ার চামরাইল, পশ্চিম মেদিনীপুরের তররুই, সাঁকোয়া এবং জলপাইগুড়ির মাটিয়ালি গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম পাঠানো হয়েছিল দিল্লিতে। কিন্তু তাদের থেকেও দিগম্বরপুরের এগিয়ে থাকার পিছনে যেটা কারণ ছিল, তা হল অনেক আগে থেকেই সমস্ত হিসেবনিকেশ কম্পিউটারের মাধ্যমে আপলোড করা থেকে অন্যান্য কাজের নথি তৈরি করায় এগিয়ে ছিল দিগম্বরপুর। একেবারে গ্রাম স্তরে আইএসজিপি প্রকল্পে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্বে উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পে শিশুবিকাশ এবং মহিলাদের প্রথম সারিতে রাখা হয়। এ ছাড়াও গ্রামে জৈব চাষ, কঠিন ও তরল বর্জ্য থেকে সার তৈরি বা বাল্যবিবাহ রোধের কাজও হয় পঞ্চায়েতের উদ্যোগে। জলাধার নির্মাণ থেকে মহিলা সমবায় সমিতি গঠনেও বাংলার অনেক এলাকার থেকে এগিয়ে দিগম্বরপুর। এমনই দাবি রবীন্দ্রনাথের।
২০১৮ সালে এই পঞ্চায়েতের প্রধান পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যায়। নুরজাহান খাতুন বেগম জেতেন। এ বারেও পদটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। ফলে জয় পেলেও ‘প্রধান’ হতে পারবেন না রবীন্দ্রনাথ। তবে তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। বললেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, কাজ করার মানসিকতাটাই আসল। সেখানে রাজনীতি নেই। ঠিক মতো কাজ করলে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অর্থ পেতে অসুবিধা হয় না। আমপান-সহ কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ গিয়েছে! আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। অনেক সময়ে বরাদ্দ অর্থ প্রয়োজন না হওয়ায় ফিরিয়েও দিয়েছি।’’
বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ভাল করে পঞ্চায়েত চালানোর জন্য কী কী বলেন? রবীন্দ্রনাথ জবাব দেন, ‘‘আসলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল কথাটাই অনেকে মনে রাখেন না। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারি আইনে ঠিক যা যা বলা হয়েছে, সেগুলিই আমরা অনুসরণ করি। অতিরিক্ত কিছু নয়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আসল কথা— একেবারে নিচুতলা থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব। দিগম্বরপুরে ঠিক সেটা করারই চেষ্টা হয়। আগামিদিনেও হবে।’’