কিরণময় নন্দের সঙ্গে মুলায়ম সিংহ যাদব। ফাইল চিত্র।
‘নেতাজি’র সঙ্গে আমার প্রায় ৩০ বছরের সম্পর্ক আচমকাই সোমবার সকালে শেষ হয়ে গেল। পরিচয় হওয়ার পর থেকে মুলায়ম সিংহ যাদবকে ‘নেতাজি’ সম্বোধনেই ডাকতাম। তিনি যে নেই, এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না!
সেটা ১৯৯২ সাল। আমি তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্যমন্ত্রী। এক দিন সকালে খবরের কাগজে দেখলাম, মুলায়ম নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করছেন। পরের দিন সকালেই ওঁকে ফোন করলাম। পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি বাংলায় সোশ্যালিস্ট পার্টি করি। বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীও। মুলায়মের কাছে আর্জি জানালাম, আমি ওঁর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দর্শন মেনে কাজ করতে চাই। আমার আর্জি শুনেই উনি আমাকে লখনউ ডেকে পাঠালেন।
গেলাম। অনেক ক্ষণ আলোচনা হল তাঁর বিক্রমাদিত্য রোডের বাড়িতে বসে। এখনও দিনটা স্পষ্ট মনে আছে আমার। সামনে বসে মুলায়ম। আর বাংলা থেকে যাওয়া এই আমি ওঁকে বলে চলেছি, রামমনোহর লোহিয়ার ছাত্র আপনি। তাঁর দর্শন মেনেই রাজনীতির পথে চলছেন। আপনার উচিত, সোশ্যালিস্ট পার্টি তৈরি করে দেশকে পথ দেখানো। আমার এ সব কথা শুনে সামনে বসে থাকা মুলায়মের চোয়ালটা শক্ত হতে দেখছিলাম। সেই দিন থেকেই উনি আমার ‘নেতাজি’। আমৃত্যু তাই ছিলেন। আজকের পরে তা-ই-ই থাকবেন।
এর কয়েক দিনের মধ্যেই বেণীপ্রসাদ বর্মা, ভগবতী সিংহের মতো নেতাদের পাশাপাশি আমাকে নিয়ে পথ চলা শুরু করলেন ‘নেতাজি’। সোস্যালিস্ট পার্টি নাম নিয়ে নির্বাচন কমিশনে সমস্যা তৈরি হল। তখন ঠিক হল, দলের নাম হবে সমাজবাদী পার্টি। বাংলা, হিন্দি, উর্দু— সব ভাষাভাষীর কাছে দেশের সব প্রান্তেই এই নাম সহজে গৃহীত হবে। দলের প্রথম অধিবেশনে আমিই ‘নেতাজি’কে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দিলাম। সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই সভাপতি হলেন সমাজবাদী পার্টির। আর আমি হলাম সাধারণ সম্পাদক। আজ সেই দিনটার কথা ভীষণ মনে পড়ছে!
কেউ কেউ বলেন, লালুর আপত্তিতে মুলায়মের আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি।
তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ‘নেতাজি’ বাংলায় এলে ওঁকে জ্যোতিবাবুর কাছে নিয়ে যেতাম। ‘নেতাজি’ আন্তরিক ভাবে চেয়েছিলেন, জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হোন। ১৯৯৬ সালে যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা, তখন আমিই দিল্লির বঙ্গভবনে জ্যোতিবাবুর কাছে নিয়ে যাই ‘নেতাজি’কে। তিনি জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। জ্যোতিবাবু সে দিন কী বলেছিলেন ‘নেতাজি’কে, সে কথাও আজ কানে বাজছে। বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘আমাদের তো মাত্র ৬৫-৬৬ জন সাংসদ! কী ভাবে প্রধানমন্ত্রী হব?’’ ‘নেতাজি’ তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জ্যোতিবাবুকে আশ্বস্ত করেছিলেন। রাম হেগড়ে, দেবগৌড়া, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো নেতারা সবাই তখন জ্যোতি বসুকেই চাইছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু তাঁর দলের আপত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। উল্টে তিনি চেয়েছিলেন মুলায়ম প্রধানমন্ত্রী হন। সবাই সম্মত হলেন। এক জনই কেবল মুলায়মের নামে সম্মতি দিলেন না। আজ তাঁর নাম করে আর বির্তক বাড়াতে চাই না।
‘নেতাজি’ অনেক দূরদর্শী ছিলেন। ’৯২ সালে যখন আমরা জানতে পারলাম, বাবরি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা হচ্ছে, সেই সময়, ২ ডিসেম্বর ‘নেতাজি’র নেতৃত্বে আমরা গিয়েছিলাম তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার কাছে। আজম খান-সহ আমরা ৫ জন শঙ্করদয়ালের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়ে জানিয়ে এলাম কী হতে চলেছে! আমাদের আশঙ্কাকে সত্যি করে তার ৪ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা হল। আমার উপস্থিতিতেই ‘নেতাজি’ ফোন করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের দফতরে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা হল, ‘‘পিএম এখন বিশ্রাম করছেন। বিকেল তিনটেয় ফোন করুন।’’
দুঃখের দিনে এবং খারাপ সময় কী ভাবে কর্মীদের পাশে থাকতে হয়, সেটা জানতেন ‘নেতাজি’। ফাইল চিত্র।
দুঃখের দিনে এবং খারাপ সময় কী ভাবে কর্মীদের পাশে থাকতে হয়, সেটা জানতেন ‘নেতাজি’। ২০১১ সালে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে বামফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থী হয়ে অল্প ভোটে হেরে গেলাম। ওই দিনই রাত ১০টায় ‘নেতাজি’ আমায় ফোন করলেন। বললেন, ‘‘আপনি উত্তরপ্রদেশে আসুন। এখানে কাজ করব। আগামী বছর উত্তরপ্রদেশে ভোট রয়েছে।’’ ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে ঐতিহাসিক জয় পেল সমাজবাদী পার্টি। ৬১টি জনসভা করেছিলাম ‘নেতাজি’র সঙ্গে। ওঁর ছেলে অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, আমাকে উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভায় পাঠালেন ‘নেতাজি’ই। আমাকে বলেছিলেন, ‘‘যদি একটি আসনও রাজ্যসভার জন্য পেতাম, আপনাকে পাঠাতাম।’’
পরাধীন ভারতে সুভাষচন্দ্র বসুকেই সবাই ‘নেতাজি’ বলে জানতেন। আর স্বাধীন ভারতের ‘নেতাজি’ আমাদের মুলায়ম সিংহ যাদব। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে লোকসভা ও রাজ্যসভায় সকলে ওঁকে ‘নেতাজি’ বলেই ডাকতেন। মুলায়ম আমাদের কাছে ‘নেতাজি’ হিসাবেই বেঁচে থাকবেন।
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বর্তমানে সমাজবাদী পার্টির নেতা)