দ্বিতীয় স্ত্রীর জীবনাবসানের চার মাসের ব্যবধানে প্রয়াত সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদব। বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিজীবন ঘিরেও বিস্তর চর্চা চলেছে। বিশেষত, প্রথম বিয়ের পর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা গুপ্তের সঙ্গে মুলায়মের প্রেমকাহিনি দেশের রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল।
চলতি বছরের জুলাই মাসে গুরুগ্রামের যে হাসপাতালে প্রয়াত হন সাধনা, সেই মেদান্ত হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন জাতীয় রাজনীতির দ্বিতীয় ‘নেতাজি’।
সাধনা গুপ্ত ছিলেন মুলায়মের দ্বিতীয় স্ত্রী। শোনা যায়, প্রথমে তাঁকে স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতিই দেননি মুলায়ম। চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রেখেছিলেন মুলায়ম। আর এ নিয়েই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল লখনউ দরবারে। যার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয় রাজনীতিতেও।
মুলায়মের প্রথম স্ত্রী ছিলেন মালতী দেবী। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ যাদবের মা তিনি। ১৯৭৩ সালে অখিলেশের জন্মের পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মালতী দেবী।
এক সময় অসুস্থ মালতী দেবীর শুশ্রুষা করতেন সাধনা। এ কথা ‘বদলাও কি লেহর’ নামে আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন অখিলেশ।
শোনা যায়, মালতী দেবীকে ভুল ইঞ্জেকশন দিচ্ছিলেন এক নার্স। তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে নার্সকে থামান সাধনা। তাঁর জন্যই সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মালতী দেবী। ওই বইয়ে এ কথা তুলে ধরেছেন অখিলেশ।
যে ভাবে মালতী দেবীর প্রাণরক্ষা করেন সাধনা, তাতে মুগ্ধ হন মুলায়ম। এ ঘটনার পর থেকেই সাধনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন শুরু হয়।
শোনা যায়, প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকার সময়ই সাধনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন মুলায়ম। সাধনার প্রথম স্বামী ছিলেন চন্দ্রপ্রকাশ গুপ্ত। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাঁদের বৈবাহিক জীবন ছিল।
সাধনার সঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রথমে প্রকাশ্যেই আনেননি মুলায়ম। স্ত্রী হিসাবে প্রথমে স্বীকৃতিও দেননি। এমনকি সাধনার প্রথম পক্ষের সন্তান প্রতীককে ছেলে হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাননি এই দুঁদে রাজনীতিক।
১৯৯৪ সালে প্রতীকের স্কুলের আবেদনপত্রে বাবা হিসাবে মুলায়মের নাম লেখা হয়। কিন্তু তখনও সৎছেলে হিসাবে তাঁকে স্বীকৃতি দেননি মুলায়ম। যদিও শোনা যায়, প্রতীককে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি।
২০০৩ সালে মুলায়মের প্রথম স্ত্রী মালতী দেবীর মৃত্যু হয়। তার পর থেকে সাধনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও মজবুত হতে শুরু করে বলে শোনা যায়।
২০০৭ সালে জল্পনা ছড়ায় যে, সাধনাকে বিয়ে করেছেন মুলায়ম। পরে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলায় ওই বছরই সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হলফনামায় সাধনাকে স্ত্রী হিসাবে তথ্য তুলে ধরেন মুলায়ম। পাশাপাশি সাধনা-পুত্র প্রতীক যাদবও তাঁর সন্তান বলে জানান এসপির প্রতিষ্ঠাতা।
মুলায়মের সঙ্গে সাধনার ঘনিষ্ঠতা কখনই পছন্দ করেননি অখিলেশ। বাবার এই সিদ্ধান্তে চটেছিলেন অখিলেশ। সে কারণে আলাদা জায়গায় থাকতে শুরু করেন তিনি।
মালতী দেবীর মৃত্যুর পরই আনুষ্ঠানিক ভাবে সাধনাকে বিয়ে করেন মুলায়ম। বয়সে মুলায়মের থেকে ২০ বছরের ছোট ছিলেন সাধনা।
মুলায়মের ছত্রছায়ায় থাকতে থাকতে রাজনীতির অঙ্ক কষা শুরু করেন সাধনাও। সমাজবাদী পার্টিতে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। তবে মুলায়মকে বিয়ের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান সাধনা।
সাধনার ভাই প্রমোদ গুপ্তও সক্রিয় রাজনীতি করেন। বিধায়কও হয়েছিলেন তিনি। তবে চলতি বছরে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে এসপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজেপিতে যোগ দেন প্রমোদ।
মুলায়মের পরিবারের দ্বন্দ্ব নিয়েও কম চর্চা হয়নি! প্রায়ই পারিবারিক কোন্দলের খবর শিরোনামে আসে। মুলায়মের ভাই শিবপাল যাদবের সঙ্গে অখিলেশের সঙ্ঘাত ঘিরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ রাজনীতিতে।
শুধু কী তাই! মুলায়ম বনাম অখিলেশ সঙ্ঘাতেরও সাক্ষী থেকেছে লখনউয়ের রাজনীতিও। দলের সভাপতি পদ থেকে মুলায়মকে সরিয়েছিলেন খোদ অখিলেশ।
চলতি বছর উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এসপি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সাধনা-পুত্র প্রতীকের স্ত্রী অপর্ণা যাদব। যার জেরে মুলায়মের ঘরে দুই শিবিরের আড়াআড়ি বিভাজন আরও সুস্পষ্ট হয়।
এ তো গেল মুলায়মের পারিবারিক কিস্সার কথা! তবে বেফাঁস মন্তব্যে বিতর্ক বাড়িয়েছেন খোদ মুলায়মই। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড— এর বিরোধিতা করে মুলায়ম বলেছিলেন, ‘‘ছেলেরা তো ছেলেই হয়...ওরা ভুল করে থাকে।’’ এই মন্তব্য ঘিরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
মুলায়মের সম্পত্তির পরিমাণও নেহাত কম নয়। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামায় জানা গিয়েছিল, ১৫ কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তি রয়েছে তাঁর।
২০২২ সালের ১০ অক্টোবর, দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হয়েছেন মুলায়ম সিংহ যাদব। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মতোই রঙিন তাঁর প্রেমকাহিনি। একইসঙ্গে তাঁকে ঘিরে থাকা বিতর্কগুলি এখনও চর্চায় রয়েছে।