বড়মার শততম জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়। —ফাইল চিত্র।
যে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের ভরসায় এক সময়ে একের পর এক ভোটের বৈতরণী পার করেছিল তৃণমূল, সেই মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িকে তিনি ‘শেষ করেছেন’ বলে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন ঠাকুরবাড়ির ছেলে, বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। এই প্রসঙ্গেই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়র সম্পর্ক নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ, ঠাকুরবাড়ির অন্য এক সদস্য মমতা ঠাকুরের অবশ্য দাবি, শেষ তো নয়ই, বরং ঠাকুরবাড়ির বহু উন্নয়ন করেছেন জ্যোতিপ্রিয়।
উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়াদের ধর্মীয় পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি। এই গাইঘাটা থেকেই ২০০১ সালে প্রথম বার তৃণমূলের টিকিটে জিতে বিধায়ক হন জ্যোতিপ্রিয়। সে সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড়। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির বর্তমান সহ সভাপতি, তৃণমূলের গোবিন্দ দাসের কথায়, ‘‘বালুকে (এ নামেই বেশি পরিচিত জ্যোতিপ্রিয়) আমিই বুঝিয়ে ছিলাম মতুয়াদের বিষয়টি।’’ তৃণমূলের নেতারা এক বাক্যে স্বীকার করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতুয়া ঠাকুরবাড়ি এবং মতুয়াদের ‘বড়মা’, প্রয়াত বীণাপাণি ঠাকুরের সেতুবন্ধনের কাজটা করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়ই। মতুয়া ভোটব্যাঙ্ককে তৃণমূলের দিকে টেনে আনার গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরনগরে দলের তফসিলি সেলের রাজ্য সম্মেলন করেছিলেন। তখন থেকে শান্তনুর বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর এবং বড়মার সঙ্গে তাঁর সখ্য। ‘বড়মা’র সঙ্গে মমতার কার্যত মা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল বলে দাবি করেন তৃণমূল নেতারা। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মতুয়াদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার ঝুলি উপুড় করে দেন মমতা। সে সময়ে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। প্রায় সব সফরেই সঙ্গী থাকতেন জ্যোতিপ্রিয়। বড়মার জন্মদিনে, পুজোর সময়ে মমতার দেওয়া শাড়ি-ফল-মিষ্টি জ্যোতিপ্রিয়ই পৌঁছে দিতেন।
উত্তর ২৪ পরগনা তো বটেই, রাজ্যের প্রায় ৭০টি কেন্দ্রে মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রভাবের কথা মানেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পিছনে মতুয়াদের বড় অংশের সমর্থন ছিল বলেও মনে করা হয়। পরের নানা ভোটেও মতুয়ারা নিরাশ করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলকে। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে জ্যোতিপ্রিয়ের পরামর্শেই মঞ্জুলকৃষ্ণকে মমতা গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিলেন। জ্যোতিপ্রিয় সরে যান হাবড়া কেন্দ্রে। সে বার জিতে মঞ্জুল মন্ত্রী হয়েছিলেন। ভোটের প্রচারে গোবরডাঙার সভামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাজির ছিলেন বড়মা। জ্যোতিপ্রিয়ের দৌত্যেই তা সম্ভব হয়েছিল বলে মানেন দলের অনেকে।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ঠাকুরবাড়ির বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল। ভোটে জেতার পরে তাঁর মৃত্যু হয়। উপনির্বাচনে কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী মমতা ঠাকুরকে দল প্রার্থী করে। মমতা ঠাকুর জয়ী হয়ে সাংসদ হন। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঠাকুরবাড়ির কামনা সাগরের ঘাট বাঁধানো-সহ প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন। জ্যোতিপ্রিয় এখনও আমাদের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। তিনি ঠাকুরবাড়িকে শেষ নয়, ঠাকুরবাড়ির উন্নয়ন করেছেন।’’
ঠাকুরবাড়ির একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০২১ সালের পর অবশ্য সে ভাবে আর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত করতে দেখা যেত না জ্যোতিপ্রিয়কে। শেষ এসেছিলেন সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের আগে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব জোয়ার কর্মসূচি উপলক্ষে। তত দিনে ঠাকুরবাড়ির রং বদলেছে। ২০১৯ সালে মঞ্জুলের ছেলে শান্তনু বিজেপির টিকিটে লোকসভা ভোটে জিতে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হন। মঞ্জুলের বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুরও ২০২১ সালে বিজেপির টিকিটে জেতেন গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সিএএ চালুর আশ্বাস দিয়ে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশকে নিজেদের দিকে টানে বিজেপি।
শান্তনুর সঙ্গে তাঁর জেঠিমা মমতা ঠাকুরের কোন্দল বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। মতুয়াদের নিয়ে তৈরি দু’টি পৃথক ধর্মীয় সংগঠনের তাঁরা দু’জন কর্ণধার। সেখানেও ভক্তদের মধ্যে বিজেপি-তৃণমূল ভাগাভাগি স্পষ্ট। শান্তনু কেন অভিযোগ করছেন, ঠাকুরবাড়িকে ‘শেষ করেছেন’ জ্যোতিপ্রিয়? রবিবার নিজের বাড়িতে বসে শান্তনুর দাবি, নিজের এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক স্বার্থে জ্যোতিপ্রিয় মতুয়াদের ব্যবহার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এবং বড়মার মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। তাঁদের খুন করা হয়েছিল। এর পিছনে জ্যোতিপ্রিয়ের ভূমিকা ছিল।’’ শান্তনুর দাবি, জ্যোতিপ্রিয় চেয়েছিলেন, মঞ্জুলকৃষ্ণকে ‘পুতুল’ বানিয়ে রাখতে। তিনি বলেন, ‘‘বাবা রাজি না হওয়ায় আমার জ্যাঠা কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে লোকসভায় দাঁড় করানো হয়। দু’টি পরিবারের মধ্যে বিরোধ বাধান জ্যোতিপ্রিয়ই। বাবাকে তৃণমূল ছাড়তে হয়।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ঠাকুরবাড়ির দেবত্র সম্পত্তি জ্যোতিপ্রিয়ের মদতে মমতা ঠাকুর জাল করে লিখিয়ে নিয়েছেন। ঠাকুরবাড়িতে চুরির মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁকে এক সময়ে গ্রেফতার করিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়, এমনও অভিযোগ তুলছেন শান্তনু।
সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘মঞ্জুলকৃষ্ণকে মন্ত্রী করেছিলেন বালুদা। সে সব কি শান্তনু ভুলে গিয়েছেন?’’ এ বিষয়ে তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মতুয়ারা জানেন, তাঁদের এবং ঠাকুরবাড়ির প্রকৃত উন্নয়নে যদি কেউ কিছু করে থাকেন, তা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন বালুদা।’’ সাংসদ হিসাবে শান্তনুকে গত পাঁচ বছর এলাকায় দেখাই যায়নি বলে পাল্টা কটাক্ষ করেন তিনি।